কার নামে শপথ নিতে হবে তুমি বলে দাও।
শপথ হওয়া উচিত তোমার সবচে’ প্ৰিয় জিনিসের নামে। তোমার সবচে’ প্ৰিয় কী?
তুমিই আমার সবচে’ প্রিয়।
ভালো করে ভেবেচিন্তে বল।
আমি রাতের পর রাত, দিনের পর দিন ভেবেছি। কাজেই আমি এখন শপথ করছি মবিনুর রহমানের নামে–আমি যত দিন বেঁচে থাকব…
শপথ বাক্য শেষ করার আগেই দরজা ঠেলে টিফিন কেরিয়ার হাতে ন’ দশ বছর বয়সী একটা ছেলে ঢুকল। মবিন ছেলেমানুষের মতো চেঁচিয়ে উঠল— খাওয়া চলে এসেছে, খাওয়া। ছেলেটা বিস্মিত চোখে তাকাচ্ছে। মবিন বলল, এই ছেলের নাম বুড্ডা। নাম সুন্দর না?
মিতু কিছু বলল না। মবিন কথা বলার জন্যেই কথা বলছে। আনন্দিত মানুষ অকারণে কথা বলে। অকারণে অজস্র প্রশ্ন করে। সেই সব প্রশ্নের জবাব তারা আশা করে না। মিতুর খারাপ লাগছে সে শপথের অংশটা শেষ করতে পারেনি। শপথটা শেষ করতে পারলে তার নিজের ভালো লাগত। বুড্ডা নামের ছেলেটা কোমরে হাত দিয়ে কেমন অভিভাবক অভিভাবক চোখে তাকাচ্ছে। দেখেই মনে হচ্ছে বাসায় গিয়ে বানিয়ে বানিয়ে অনেক কিছু বলবে। মিতু বলল, তোমার বুড্ডা কি এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে?
মবিন বলল, হ্যাঁ। খাওয়া শেষ হলে টিফিন কেরিয়ার নিয়ে চলে যাবে।
ওকে চলে যেতে বল, ওর সামনে বসে আমি খাব না।
বুড্ডা তুমি চলে যাও, আমি সন্ধেবোলা টিফিন কেরিয়ার নিয়ে যাব।
আইজ আফনেরে যাইতে নিষেধ করছে। আইজি আফার শইল খারাপ।
আচ্ছা যাব না। তুমি পরে এসে টিফিন কেরিয়ার নিয়ে যাবে।
ছেলেটা নিতান্ত অনিচ্ছায় চলে যাচ্ছে। মিতু বলল, রাতে তোমাকে যেতে নিষেধ করল, রাতে তুমি খাবে কোথায়?
ওরা খাবার পাঠিয়ে দেবে।
মিতু দেখল মবিন খুব আগ্রহ নিয়ে খবরের কাগজ বিছাচ্ছে, টিফিন কেরিয়ারের বাটি সাজাচ্ছে। ঘরে একটাই প্লেট। সেটা মিতুকে দেয়া হলো। মবিন বাটিতে খাবে। আয়োজন অনেক–বেগুন ভাজা, মাছ ভাজা, ঝাল ঝাল করে রান্না করা গরুর গোশত, দু’রকমের ডাল। মবিন খুশি খুশি গলায় বলল, এদের ডাল রান্না অসাধারণ হয়। তোমাকে একদিন ঐ মহিলার কাছে নিয়ে যাব। ডাল রান্না শিখে আসবে। রেসিপি কাগজে-কলমে লিখে আনলে কিছু হয় না, এসব শিখতে হয় হাতে-কলমে। যাবে একদিন আমার সাথে?
যাব।
ডালটা একটু চেখে দেখা—-অসাধারণ কিনা বল।
হুঁ অসাধারণ।
ডাল রান্নার ওপর এই মহিলাকে অনায়াসেই একটা পিএইচ.ডি. ডিগ্রি দিয়ে দেয়া যায়।
এই টিউশ্যানিটা পেয়ে তুমি মনে হয় সুখেই আছ।
খাওয়াদাওয়ার দিক দিয়ে আরামে আছি–তবে ছাত্রী পড়িয়ে কোনো আরাম পাই না।
কেন?
যতক্ষণ পড়াই ততক্ষণ ছাত্রীর মা কাছেই একটা চেয়ারে কঠিন কঠিন চোখ করে বসে থাকেন। মেয়েকে পাহারা দেন। যেদিন তিনি থাকেন না সেদিন অন্য কেউ থাকে। নিজেকে খুব ছোট লাগে।
মিতু হালকা গলায় বলল, তারা জানে না তোমার চরিত্র সাধু-সন্ন্যাসীর মতো। জানলে মেয়ের জন্যে পাহারার ব্যবস্থা করত না।
আমার চরিত্র সাধু-সন্ন্যাসীর মতো! কী যে তুমি বল! সাধু-সন্ন্যাসীদের বেশিরভাগই চরিত্রহীন। তুমি হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলো পড় নি, পড়লে বুঝতে ওদের ঋষিরা কী চীজ-হা-হা-হা।
খাওয়ার সময় এ রকম শব্দ করে হাসবে না। বিষম লাগবে।
ভাতে কি কম পড়বে?
না, কম পড়বে না।
দেখেছি। এরা কেমন চাল খায়৷ এ চালের নাম হচ্ছে কাটারিভোগ। বিয়ের পর আমরা যখন সংসার পাতব তখন এই কাটারিভোগ চালই খাব। দু’জন মানুষ, চাল তো বেশি লগবে না, কী বল?
মিতু জবাব দিল না। মবিন বলল, মাসে পনের কেজি চালের বেশি তো আমাদের লাগবে না। কাটারিভোগের কেজি কত করে তুমি জান?
জানি না। আচ্ছা, খাওয়াদাওয়া ছাড়া অন্য কোনো গল্প করলে কেমন হয়?
খুব ভালো হয়।
বেশ তাহলে অন্য গল্প বল।
অন্য গল্প তুমি বল–আমি শুনি।
আমার তো সব ছবির লাইনের গল্প। এসব গল্প শুনতে তোমার ভালো লাগবে না।
খুব ভালো লাগবে। তুমি যা বল। তাই শুনতে ভালো লাগে। কারণ কি জান?
না।
তোমার গলার স্বর অদ্ভুত সুন্দর। মনে হয় বাজনা বাজছে।
কী বাজনা–ঢোল?
জলতরঙ্গ।
সেটা আবার কী বাজনা?
চিনামাটির বাটিতে পানি ভর্তি করে কাঠি দিয়ে বাজায়। অনেকগুলো বাটি নেয়া হয়। বাটিতে পানির পরিমাণ বাড়িয়ে-কমিয়ে শব্দের ফ্রিকোয়েন্সি ঠিক করা হয়। মন্দ্র সপ্তক থেকে…
উফ! বক বক বন্ধ করা তো।
মবিন হেসে ফেলল। মিতু বলল, তোমার একটাই সমস্যা–কোনো কথা শুরু করলে সেটাকে জ্ঞানের কথায় নিয়ে ফেলবে। জ্ঞানের কথা কি আমার মতো সাধারণ মানুষের ভলো লাগে? হাত কোথায় ধোব? তোমার বাথরুম কোথায়?
বাথরুম নিচে-অনেক দূরে। তুমি বাটির মধ্যে হাত ধোও। পান খাবে? মিষ্টি পান, নিয়ে আসি।
কিছু আনতে হবে না। তুমি চুপ করে বোস আর ক্রমাগত কথা বলে যাও।
জ্ঞানের কথা?
না, মজার মজার কথা।
আমার কোন কথাগুলো তোমার মজা লাগে তাও তো জানি না। বরং তুমি তোমার বিখ্যাত জলতরঙ্গ কণ্ঠে গল্প বল আমি শুনি।
ফিল্ম লাইনের গল্প?
ফিল্ম লাইনের গল্পই তো সবচে’ ইন্টারেস্টিং হওয়ার কথা।
ফিল্ম লাইনের ভয়ংকর সব গল্প আছে, শুনলে তোমার মনটন খারাপ হয়ে যাবে–যেমন ধর, একটা মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে, টেপী তার নাম। আমার মতোই ছোটখাটো পার্ট করে। তারা তিন বোন…
ফিল্ম লাইনের মেয়ের নাম টেপী, অদ্ভুত তো। এই লাইনে নামের খুব বাহার থাকার কথা–নীলাঞ্জনা চৌধুরী টাইপ।