মবিন ভাইয়ের জন্যে একজোড়া স্যান্ডেলও কেনা দরকার। তার স্যান্ডেলের যে অবস্থা। বাড়তি কিছু টাকা পাওয়া গেছে। যখন…।
স্যান্ডেল কেনার ব্যাপারটায় সে মনস্থির করতে পারছে না। তার টাকা-পয়সার খুব টানাটানি যাচ্ছে। চার মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি পড়েছিল। ঐ দিনের দু’হাজার টাকা বাড়ি ভাড়ায় চলে গেছে। তারপরেও খালি হাতে মবিন ভাইয়ের কাছে যাওয়া যায় না।
কমদামি স্যান্ডেলও ছিল, সে ঝোঁকের মাথায় তিন শ পঁচিশ টাকা দিয়ে একজোড়া স্যান্ডেল কিনে ফেলল। মাপে হবে। এর আগের স্যান্ডেল জোড়াও তার কিনে দেয়া, সে মাপ জানে।
বাস প্রায় ফাঁকা। সে জানালার পাশে বসেছে। বাস দ্রুত চলছে। তার কেমন যেন শান্তি শান্তি লাগছে। অথচ শান্তি লাগার কিছু নেই। সে বুঝতে পারছে তার সামনে অনেক অশান্তি—মোবারক সাহেব হঠাৎ উদয় হয়েছেন কেন? সে ধরেই নিয়েছে তার জীবনের কিছু আলাদা অংশ আছে। মূল জীবনের সঙ্গে সেই জীবনের কোনো মিল নেই। মূল জীবনের সঙ্গে তা যুক্তও নয়। ওই জীবন তার নয়-অন্য একটা মেয়ের জীবন, যার নাম টেপী। সে টেপী নয়–সে রেশমাও নয়; সে মিতু। মোবারক নামের লোকটিকে টপী হয়তো চেনে, সে চেনে না।
জয়দেবপুর চৌরাস্তায় রেশমা বাস থেকে নামল। নেমেই সে মিতু হয়ে গেল। এক প্যাকেট ভালো সিগারেট কিনতে হবে। মানুষটার ভালো সিগারেটের এত শখ, টাকার অভাবে খেতে পারে না। পৃথিবীটা যদি এ রকম হতো— দোকান ভর্তি জিনিস থরে থরে সাজানো। যার যা প্রয়োজন উঠিয়ে নিয়ে যাবে, কাউকে কোনো টাকা দিতে হবে না। সিগারেট কেনার পর মিতুর মনে হলো–একটা কী যেন বাকি আছে। এর আগের বার মবিন ভাইয়ের কাছে যখন এসেছিল তখন ঠিক করে রেখেছিল। পরের বার আসার সময় অবশ্যই কিনে আনবে। এখন মনে পড়ছে না।
দরজির দোকানের ওপরে একটা ঘর নিয়ে মবিন থাকে। এক শ টাকা ভাড়া। ঘরে প্লাস্টার হয় নি–জানালা লাগানো হয় নি। জানালার খোলা অংশ করোগেটেড টিন দিয়ে বন্ধ। মবিনের ঘরে ওঠার সিঁড়ি অসম্ভব সরু। রোলিং নেই। সাবধানে উঠতে হয়। বর্ষাকাল বলে সিঁড়ি ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে। মিতু খুব সাবধানে উঠছে। তার হঠাৎ মনে হলো–এখন যদি দেখে মবিন ভাই নেই তখন কেমন লাগবে?
মবিন ঘরেই ছিল। সে দরজা খুলে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। মিতু বলল, দরজা ছাড়। দরজা ধরে থাকলে ভেতরে ঢুকবা কীভাবে?
মবিন বলল, হাত ধরে তোমাকে ভেতরে নিয়ে যাই?
সেটা আবার কী?
খুব সম্মানিত যারা তাদের হাত ধরে ঘরে ঢোকাতে হয়।
আমি কি খুব সম্মানিত?
অবশ্যই।
তাহলে হাত ধরে নিয়ে যাও।
মবিন দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল। হাত ধরল না। ধরবে না মিতু জানত। অশোভন কিছু কখনোই সে করবে না। মবিন বলল, পা তুলে আরাম করে বিছানায় বোস। তুমি কি দুপুরে খেয়ে এসেছ?
না।
তাহলে দুপুরে আমার সঙ্গে খাবে।
হোটেলের কুৎসিত খাবার? রবারের গোশত আর টকে যাওয়া ডাল?
মবিন হাসিমুখে বলল, ভালো খাবার। টিফিন কেরিয়ারে করে আসবে।
কোথেকে আসবে?
এক কনট্রাকটর সাহেবের বাসা থেকে। উনার বড় মেয়ে এসএসসি দেবে। তাকে এখন ইংরেজি শিখাচ্ছি–বিনিময়ে মাসে সাত শ টাকা পাচ্ছি প্লাস দু বেলা খাবার। রাতের খাবার ঐ বাসাতেই খাই–দুপুরেরটা তারা টিফিন কেরিয়ারে করে পাঠিয়ে দেয়।
তোমাকে এতে খুব আনন্দিত মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ আনন্দিত। মহিলার রান্না অসম্ভব ভালো। যা রাঁধে তাই অমৃতের মতো লাগে। ঐদিন আলুভর্তা বানিয়ে পাঠিয়েছে। আলুভর্তার সঙ্গে সর্ষে বেটে দিয়েছে–আর দিয়েছে ধনেপাতা। এতগুলা ভাত খেয়ে ফেলেছি শুধু আলুভর্তা দিয়ে। আচ্ছা তুমি এ রকম শক্ত হয়ে বসছ কেন? আরাম করে বোস না।
আরাম করেই তো বসেছি।
আরো আরাম করে বোস। দেয়ালে হেলান দিয়ে বোস।
মিতু দেয়ালে হেলান দিয়ে বসল। মবিন বলল, তোমার খবর কী বল?
মিতু হাসিমুখে বলল, বলার মতো কোনো খবর নেই। তোমার খবর কী?
আমার দু’টা খবর আছে–একটা ভালো, একটা খারাপ। কোনটা আগে শুনতে চাও?
ভালোটাই আগে শুনি।
আমার ঘরের জানালা লাগানো হচ্ছে, এখন বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি আকাশ দেখতে পারব।
খারাপ খবরটা কী?
খারাপ খবর হলো–জানালা ফিট করায় ঘরের ভাড়া বেড়ে যাচ্ছে। কত বাড়ছে বলতে পারছি না, তবে বাড়ছে…
মবিন হাসছে। মিতু মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। এভাবে দীর্ঘ সময় কারো দিকে তাকিয়ে থাকতে নেই–এতে যার দিকে তাকিয়ে থাকা হয় তার অমঙ্গল হয়। নজর লেগে যায়। মিতু চোখের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, আমি তোমার জন্যে উপহার এনেছি। বল তো কী?
চিরুনি।
কী করে বুঝলে?
শেষবার যখন এসেছিলে তখন আমার চিরুনি দেখে বলে গেছ আমাকে একটা চিরুনি উপহার দেবে। এই আশায় আমি চিরুনি কিনি নি। আঙুল দিয়ে চুল আঁচড়াই।
সত্যি আঙুল দিয়ে চুল আঁচড়াও?
হুঁ।
আমি কিন্তু চিরুনি আনি নি। ভুলে গেছি। আমার মনে হচ্ছিল কী একটা জিনিস যেন ভুলে গেছি। তোমার জন্য একজোড়া স্যান্ডেল এনেছি।
সিগারেট? সিগারেট আন নি?
হুঁ।
দেখি দাও।
মিতু সিগারেটের প্যাকেট বের করে দিল। মবিন প্যাকেট হাতে নিতে নিতে বলল, আমাদের বিয়ের পরেও কি তুমি আমাকে উপহার দেবে?
আমি যতদিন বেঁচে থাকব, দেব।
কীসের শপথ?
সূৰ্য এবং চন্দ্রের শপথ।
সূৰ্য এবং চন্দ্রের নামে তো মানুষ চিরকাল শপথ নিচ্ছে–তুমি নতুন কিছুর নামে নাও।