জানি না।
সবাই জানে। তুমি কিছু জান না–এটা কেমন কথা। সত্যি জান না?
না।
তাহলে শোন আমার কাছে। সে এক ইতিহাস…
ইতিহাস শোনা হলো না। রেশমাদের একজন প্ৰডাকশন বয় ক্যান্টিনে ঢুকেছে। সে রেশমাকে দেখে রাগী গলায় বলল, ওস্তাদ তোমারে খুঁজে।
রেশম চা রেখেই উঠতে যাচ্ছিল। দিলদার বলল, চা শেষ করে তারপর যাও। যত বড় ওস্তাদই হোক–খাওয়া ফেলে ছুটে যেতে হবে না। তাছাড়া শুটিং তো আজ হচ্ছে না। পুরো এফডিসি প্যাকআপ।
চা আগুনগরম। দ্রুত খাওয়া যাচ্ছে না। দিলদার বলল, ম্যাডাম আস্তে আস্তে খান। জিভ পুড়ে কয়লা হয়ে যাবে। হা করলে দেখা যাবে কুচকুচে কালো জিভ।
জমিলা মেয়েটি এই রসিকতায় খুব হাসছে। মেয়েটা সুন্দর। সত্যিকার রূপবতী মেয়েদের লক্ষণ হলো হাসলেও এদের সুন্দর দেখা যায়। বেশিরভাগ রূপবতী মেয়ে হাসলে কুৎসিত হয়ে যায়। এই মেয়েটা হচ্ছে না। সে যতই হাসছে ততই সুন্দর হচ্ছে।
রেশম চায়ের টাকা দিতে গেল। দিলদার হুংকার দিয়ে উঠল, খবরদার ম্যাডাম। তুমি দিলদারের গেস্ট। ভিজিটিং কার্ডটা যত্ন করে রেখে দিও–কখন দরকার হয় কে জানে। রাত ন’টার পর টেলিফোন করলে পাবে। অনেক সময় টেলিফোন লাইন নষ্ট থাকে–তখন সরাসরি চলে আসবে, অ্যাড্রেস লেখা আছে।
ন’নম্বর শুটিং ফ্লোরে লোকজন নেই। এক ঘণ্টা আগে প্যাকআপ হয়েছে। এতক্ষণ লোক থাকার কথা না। লাইট সরানো হয় নি। সেকেন্ড শিফটে কাজ হবে–কাজেই যেটা যেখানে আছে সেখানেই থাকবে। আজমল তরফদার এখন বাড়ি যাবেন না। শট ডিভিশনের কিছু কাজ বাকি আছে। কাজ শেষ করবেন। ট্রলি শট যে কটা ছিল সব বদলাতে হচ্ছে। ফ্লোর উঁচুনিচু হয়েছে। ট্রলি স্মুথলি মুভ করছে না। ক্যামেরা কাঁপছে।
আজমল তরফদার চোখ বন্ধ করে চেয়ারে বসে আছেন। তাঁর মাথা ধরেছে। একজন ফ্লোর-ব্যয় তাঁর মাথা টিপে দিচ্ছে। তাঁর ঠিক দু’হাত পেছনে ফ্লোর ফ্যান বসানো হয়েছে। ফ্যান থেকে বাতাস যত না হচ্ছে শব্দ হচ্ছে তারচেয়েও বেশি।
রেশমা আজমল তরফদারের সামনে দাঁড়াল। ভয়ে ভয়ে বলল, আজমল ভাই, আমাকে খবর দিয়েছেন? আজমল তরফদার চোখ মেললেন, চোখ টকটকে লাল। এটা কোনো অসুখ না বা রাত্রি জাগরণের ফলও না। সব সময় তাঁর চোখ এ রকম। প্রথমবার দেখলে মনে হয়–কিছুক্ষণ আগেই আলতা দিয়ে চোখ ধোয়া হয়েছে।
আজমল তরফদার চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন। যে ফ্লোর-বয় মাথা বিলি দিয়ে। দিচ্ছিল তাকে বললেন, ঠাণ্ডা এক গ্লাস লেবুর শরবত আমার জন্যে আন। চিনির শরবত না, লবণের শরবত।
রেশমা দাঁড়িয়ে আছে। এই মানুষটাকে তার ভয় ভয় লাগে। তবে মানুষটা ভালো। মেয়েদের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টির কোনো বদনাম এই মানুষটার নেই।
রেশমা তোমার নাম?
জ্বি।
দাঁড়িয়ে আছ কেন? বোস।
বসার জন্যে চেয়ার বা টুল কিছুই নেই। বসতে হলে মেঝেতে বসতে হয়। রেশম মেঝেতে বসে পড়বে কিনা বুঝতে পারছে না। আজমল তরফদার হুংকার দিলেন–এই কেউ নেই, এখানে চেয়ার দিয়ে যা।
ফ্লোর-ব্যয় চেয়ার নিয়ে ছুটে এল। রেশমার অস্বস্তি লাগছে। এক্সট্রা মেয়ের জন্যে কোনো পরিচালক হুংকার দিয়ে চেয়ার আনায় না। রহস্যটা কী?
বোস। চা খাবে?
জ্বি না।
তাহলে ঠাণ্ডা কিছু খাও।
জ্বি না।
বার বার না বলবে না। বার বার না শুনতে ভালো লাগে না। ফ্লোরে কে আছে, ঠাণ্ডা কোক আন।
গ্লাসভর্তি কোক হাতে রেশমা জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। তার মাথা ঘুরছে, সে কিছুই বুঝতে পারছে না। আজমল তরফদার আবার চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করেছেন। ফ্লোর-ব্যয় তার মাথার চুল টেনে দিচ্ছে।
রেশমা।
জ্বি।
তুমি মোবারক সাহেবকে চেন?
জ্বি না।
আজমল তরফদার চোখ মেললেন। টকটকে লাল চোখ দেখলেই ভয় লাগে। তিনি ভুরু কুচকে বললেন, মোবারক সাহেবকে চেন না?
জ্বি না।
জাহাজের ব্যবসা করেন যিনি সেই মোবারক। টেক্সটাইল মিল আছে–মোবারক টেক্সটাইলস–কোটিপতির ওপরে যদি কিছু থাকে সেই পতি।
জ্বি না, আমি চিনি না।
কোনোদিন তাঁর সঙ্গে দেখা হয় নি?
জ্বি না।
ও আচ্ছা। ঠিক আছে এইটা জানার জন্যে।
আমি চলে যাব আজমল ভাই?
আচ্ছা যাও। শোন শোন তোমার পেমেন্ট হয়েছে?
জ্বি না, মিজান ভাই বলেছেন কোনো কাজ হয় নাই। সেজন্য পেমেন্ট হবে না।
তোমার পেমেন্ট হবে। অফিস থেকে পেমেন্ট নিয়ে যাও–আমি ম্যানেজারকে টেলিফোন করে দেব। আচ্ছা এখনি করছি।
আজমল তরফদার কর্ডের কোটের পকেট থেকে সেলুলার টেলিফোন বের করলেন। রেশমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। ব্যাপারটা কী।
আজ ম্যানেজার মুনশি রেশমাকে দেখামাত্ৰ ভাউচার বই বের করল। রেশমা সই করতে গিয়ে দেখে পাঁচ শ টাকা লেখা। তার পেমেন্ট দিন হিসেবে। এক দিনে তার প্রাপ্য হয় আড়াই শ। দেয়া হচ্ছে পাঁচ শ।
মুনশি টাকা বের করতে করতে বলল, চা খাবেন?
এও এক বিস্ময়কর ব্যাপার। বাণী কথাচিত্রের ম্যানেজার মুনশি তাকে আপনি করে বলছে।
চা খাব না। আমার কাজ আছে। যাই?
জ্বি আচ্ছা।
তার কোনো কাজ নেই। শুটিং প্যাকআপ হওয়ায় সারাটা দিন তার হাতে। সেকেন্ড শিফটে কাজ হবে। সেকেন্ড শিফট কাগজে-কলমে বিকেল চারটা থেকে শুরু হলেও ফ্লোর ম্যানেজার বলে দিয়েছে কাজ শুরু হবে মাগরেবের নামায্যের পর। এই দীর্ঘ সময় এফডিসিতে বসে থাকার কোনো অর্থ হয় না। মবিন ভাইয়ের মেসে হুট করে চলে যাবে নাকি? অনেকদিন যাওয়া হয় না। এই সময় তাকে মেসেই পাওয়ার কথা। সকাল, বিকাল, সন্ধ্যা আর রাত এই সময়গুলোতে মবিন ভাই ব্যস্ত থাকেন–প্ৰাইভেট পড়ান। বিকেলের আগ পর্যন্ত সময়টা অবসর।