তিনি স্ত্রীর দিকে তাকালেন। এত বিরক্তি এবং এত রাগ নিয়ে তিনি তার নীর এর আগে তাকান নি।
পাতলা একটা জামা গায়ে দিয়ে আছ, তোমার ঠাণ্ডা লাগছে না? আমি তো শীতে মরে যাচ্ছি। ঘুম আসছে না?
না।
ঘুমের ওষুধ খাবে? না খাওয়াই ভালো–একবার খেলে অভ্যাস হয়ে যায়। আমাকে দু’তিনটা সিডাকসিন না খেলে তন্দ্রা পর্যন্ত আসে না। এস, ভেতরে এল। ইস্রে কী ঠাণ্ডা!
তিনি ঘরে ঢুকলেন। বিছানায় ঘুমুতে গেলেন এবং বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়লেন। তিনি বোকা নন, তিনি বুদ্ধিমান মানুষ, যা ঘটেছে তা যে আবারো ঘটবে তা তিনি জানেন। তিনি যদি বেঁচে থাকতে চান সেই পথ তাঁকে খুঁজতে হবে। এখানে সাহায্য করার আসলে কেউ নেই।
বিলেতে তিনি এক নামি সাইকিয়াট্রিন্টের কাছে গিয়েছিলেন। এক এক সিটিঙে। এই ভদ্রলোক পঁচাত্তর পাউন্ড করে নেন। রঙচঙে পোশাক পরা এক বুড়ো, যে ফুর্তিবাজের ভূমিকায় অভিনয় করার চেষ্টা করছে। অভিনয় ভালো হচ্ছে না। মোবারক সাহেব চট করে সেই অভিনয় ধরে ফেললেন এবং বুড়োর জন্যে একটু মায়াও লাগল।
বুড়ো বলল, তোমার সমস্যাটা কী?
মোবারক সাহেব বললেন, আমার কোনো সমস্যা নেই।
আমার কাছে এসেছে কেন?
গল্প করতে এসেছি।
বোস। বোস। আরাম করে বোস এবং গল্প কর। গল্প তুমি করবে, না। আমি করব?
মোবারক সাহেব বললেন, দু’জনে মিলেই করব। প্ৰথমে তুমি শুরু করা–দেখি তোমার গল্পটা ইন্টারেস্টিং কিনা। তুমি নিশ্চিত তোমার কোনো সমস্যা নেই?
আমি নিশ্চিত।
তাহলে তো তুমি মানুষ না, তুমি ফার্নিচার গোত্রীয়–টেবিল বা চেয়ার। মানুষ হলে সমস্যা থাকতেই হবে।
তোমাদের বিদ্যা তাই বলে?
হ্যাঁ, তাই বলে। প্রচুর সমস্যা থাকবে–তোমরা আমাদের কাছে আসবে। আমরা খেয়ে পরে বঁচিব, তোমরাও পাউন্ড খরচের একটা জায়গা পাবে–হা-হা-হা।
মোবারক সাহেব লক্ষ করলেন, বুড়ো নকল হাসি হাসছে। এদের কাছে আসা অর্থহীন। তারপরেও কিছু কথাবার্তা হলো। তিনি এক সময় জানতে চাইলেন–মানুষ মরতে চায় কেন?
বুড়ো কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, অসংখ্য কারণে মানুষ মরতে চায়, তুমি কী জন্যে চাচ্ছ সেটা তুমি জান।
মোবারক সাহেব মনে মনে বুড়োর বুদ্ধির প্রশংসা করলেন। একটা সিটিঙে যে পঁচাত্তর পাউন্ড নেয়। তার কিছু বুদ্ধি তো থাকতেই হবে। বুড়োর সঙ্গে আলাপ করে মোবারক সাহেবের কোনো লাভ হয় নি। তার সমস্যা তিনি জানেন। তিনি বিস্মিত হবার ক্ষমতা নষ্ট করে ফেলেছেন। তাঁকে বেঁচে থাকতে হলে বিস্মিত হবার ক্ষমতা ফিরে পেতে হবে। কিংবা এমন কাউকে পাশে লাগবে যার বিস্মিত হবার ক্ষমতা প্ৰবল।
বইয়ের দোকান থেকে তিনি স্বপ্নের উপর দু’টা বই কিনলেন। সেলস গার্ল হাসিমুখে বলল, তুমি বুঝি খুব স্বপ্ন দেখ?
মেয়েটার কথা তাঁর ভালো লাগল। এই মেয়েটি রোবট হয়ে যায় নি। তার বিস্মিত হবার ক্ষমতা আছে। দু’টা স্বপ্নের বই কিনতে দেখে সে বিস্মিত হয়েছে।
তুমি কি আর কোনো বই নেবে?
সুইসাইডের উপর কোনো বই আছে?
হ্যাঁ আছে। Anatomy of Suicide.
পাঁচ শ পৃষ্ঠার বিরাট একটা বই। তিনি ডলার দিচ্ছেন। মেয়েটা কৌতুহলী হয়ে তাকে দেখছে।
রেশমা ক্যান্টিনে চা খেতে ঢুকেছে
রেশমা ক্যান্টিনে চা খেতে ঢুকেছে। এফডিসির ক্যান্টিনে এই সময় জায়গা পাওয়া মুশকিল-আজ ফাঁকা। শুধু যে ক্যান্টিন ফাঁকা তাই না–পুরো এফডিসিই ফাঁকা। সবার শুটিং প্যাকআপ হয়ে গেছে–ফাইটার গ্রুপের একটা ছেলে মারা গেছে। শুটিং এই কারণে বন্ধ। ক্যান্টিনের ম্যানেজার বিরস মুখে বসে আছে। এক কোণায় দিলদার খাঁ বৃদ্ধা একজন এক্সট্রার সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে–নানি নানি করে ডাকছে। নানির সঙ্গে ঝলমলে পোশাক পরা এক কিশোরী। চোখ বড় বড় করে সে গল্প শুনছে। দিলদারের দৃষ্টি কিশোরীর দিকে। রেশমাকে দেখে দিলদার খাঁ আনন্দিত গলায় বলল, এই যে ম্যাডামকে পাওয়া গেছে। আস আস। কিশোরী মেয়েটি প্রবল বিস্ময়ে তাকে দেখছে। সত্যি সত্যি রেশমাকে বোধহয় নায়িকা ভেবেছে। রেশমা এগিয়ে গেল। দিলদার খাঁ দরাজ গলায় বলল, ম্যাডামকে চা দাও। সিঙ্গাড়া দাও। তারপর ম্যাডাম, খবর কী?
কোনো খবর নাই।
শুটিং নাকি আবার শুরু হয়েছে। খবর নাই বলছি কেন? এইটাই তো বড় খবর।
দিলদার ব্যস্ত হয়ে মানিব্যাগ বের করল। রঙচঙে একটা কার্ড বের করে বলল, নাও যত্ন করে রাখ।
এটা কী?
ভিজিটিং কার্ড। ছাপিয়ে ফেললাম। অ্যাড্রেস টেলিফোন নাম্বার সব লেখা আছে।
ভালো করেছেন। ভালো মন্দ জানি না, যে ব্যবসায় যে চাল। এখনকার চাল হচ্ছে–দু’টা কথা বলার পরই হাতে ভিজিটিং কার্ড গুঁজে দেয়া। কিছুদিন পর দেখব লোকজনের দেখা হবে কিন্তু কথাবার্তা হবে না। দু’জন দু’জনের হাতে ভিজিটিং কার্ড দিয়ে যে যার পথে চলে যাবে—হা-হা-হা।
বৃদ্ধার চা খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। সে বলল, দিলদার ভাই উঠি?
দিলদার বলল, আরো না এখনই কী উঠবে? কথাই তো হয় নি। এই মেয়ে কে? তোমার নাতনি?
হুঁ।
চেহারা ছবি তো ভালো–অভিনয় করবে? নাম কী?
জমিলা।
আগ্রহ থাকলে কোনো এক জায়গায় ঢুকিয়ে দেব–অসুবিধা নাই। মেয়ের অবশ্য ঠোঁট মোটা, সেটা কোনো ব্যাপার না। কপালে থাকলে নায়িকা হওয়া কিছু না।
রেশমা লক্ষ করল। জমিলার চোখ চকচক করছে। রেশমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। দিলদার রেশমার দিকে ঝুকে এসে বলল, তোমাদের ছবির সমস্যা মিটমাট কীভাবে হলো?