হ্যাঁ। ঢাকার খবর কী?
দেয়ার মতো কোনো খবর নেই স্যার। সব ঠিকঠাক আছে।
জুনের আঠার তারিখ মংলা পোর্টে আমাদের যে জাহাজ আসার কথা সেটা ঠিক আছে?
স্যার এখন পর্যন্ত ঠিক আছে। এডেন হয়ে আসবে, এডেনে কোনো সমস্যা না হলে তারিখ মতোই আসবে।
সমস্যা হবার কি কোনো সম্ভাবনা আছে?
জ্বি স্যার আছে।
আচ্ছা ঠিক আছে। ভালো কথা, একটা ছবি বানাতে কী পরিমাণ টাকা লাগে তুমি জান?
স্যার আমি আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।
ছবি বানাতে, টু মেক এ ফুল লেংথ ফিচার ফিল্ম, কী পরিমাণ টাকা লগ্নি করতে হয় তুমি কি জান?
স্যার আমি জানি না, তবে আপনি বললে খোঁজ নিতে পারি।
খোঁজ নিও তো।
আমি স্যার এখনি খোঁজ নেব। খোঁজ নিয়ে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে আপনাকে জানাব।
তাড়া কিছু নেই–তুমি খোঁজ নিয়ে রাখ, এক সময় আমাকে জানালেই হবে।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
লোকমান আমি তাহলে টেলিফোন রাখি?
টেলিফোন রেখে মোবারক সাহেব রাতের কর্মকাণ্ড মনে মনে ঠিক করে ফেলেন। ক্যাব নিয়ে খানিকক্ষণ ঘুরবেন। বইয়ের দোকানে যেতে হবে–স্বপ্নতথ্য বিষয়ক বই কিনতে হবে। তারপর একটা মেক্সিকান রেস্টুরেন্ট খুঁজে বের করতে হবে। ডিনারের সঙ্গে মাৰ্গরিটা খেতে ইচ্ছে করছে। মেক্সিকান রেস্টুরেন্ট ছাড়া এই পানীয় আর কোথাও পাওয়া যায় না। জাপানি ক্যাবি ড্রাইভাররা ইংরেজি জানে না বললেই হয়। হোটেলের রিসিপশনিস্টদের সাহায্য নিতে হবে। বড় হোটেলের রিসিপশনিস্টদের সঙ্গে কথা বলতে তার ভালো লাগে না। এর যন্ত্রের মতো কথা বলে। আজ পর্যন্ত তিনি পাঁচতারা হোটেলে এমন কোনো রিসিপশনিস্ট পান নি যে মানুষের মতো কথা বলছে।
এই হোটেলের রিসিপশনিস্ট মেয়েটি এমন সাজ সেজেছে যেন সে এক্ষুণি বিশ্বসুন্দরী প্ৰতিযোগিতায় অংশ নিতে যাবে। পাতলা ঠোঁটে যে লিপষ্টিক দিয়েছে তাতে মনে হচ্ছে ঠোঁটে আগুন জ্বলছে। জাপানিরা ভালো ইংরেজি বলতে পারে না। কিন্তু মেয়েটি নিখুঁত আমেরিকান একসেন্টের ইংরেজিতে বলল, স্যার আপনার জন্যে আমি কী করতে পারি? মোবারক সাহেব বিরক্তি ও বিতৃষ্ণা নিয়ে মেয়েটিকে দেখছেন। যন্ত্র কথা বলছেমানুষ না। কঠিন কিছু বলে মেয়েটির যন্ত্র ভাবকে নষ্ট করে দিলে সে হয়তো মানুষের মতো কথা বলত।
স্যার কিছু কি করতে পারি? মোবারক সাহেবের ইচ্ছা হলো বলেন–ইয়াং লেডি, আমি খুব একা বোধ করছি। তুমি কি তোমার ডিউটি শেষ হবার পর রাতে ঘণ্টাখানেকের জন্যে আসবে? তোমাকে আমি হ্যাঁন্ডসামলি পে করব।
এ জাতীয় কথা বললে সে একটা ধাক্কা খাবে। তার রোবট ভাব এতে কাটতে পারে। মোবারক সাহেব তেমন কিছু বললেন না, মেক্সিকান রেস্টুরেন্টের ঠিকানা চাইলেন। মেয়েটি দ্রুত ঠিকানা বের করে ফেলল। হাসিমুখে বলল, আমি কি ক্যাব ঠিক করে তাকে ইনসট্রাকশান দিয়ে দেব?
দিলে খুব ভালো হয়। ইউ আর সো কাইন্ড।
প্লিজ ডোন্ট মেনশান।
সব ধরাবাঁধা কথা। সব যন্ত্রের মতো কথা। যেন আগে থেকে প্রোগ্রাম করা।
রেহানাও তো এরকম। সে কোনো পাঁচতারা হোটেলের রিসিপশনিস্ট নয়। কিন্তু সে যখন কথা বলে তখন সেও তো তার ধরাবাধা গৎ-এ চলে আসে। এর বাইরে যেতে পারে না। এর বাইরে কথা বলতে পারে না। আসলে সব মানুষই কি এ রকম নয়? তিনি নিজেও কি একজন রোবট না?
মানুষ রোবট কীভাবে হয়? চট করে হয় না–খুব ধীরে ধীরে হয়। কাজেই এই প্রক্রিয়া বোঝা যায় না–এক ভোরবেলা ঘুম থেকে জেগে দেখে সে রোবট হয়ে গেছে। তখন সে আতংকে অস্থির হয়ে যায়। তিনি নিজে কি এখন আতংকে অস্থির হয়েছেন? হ্যাঁ হয়েছেন। সারাক্ষণ তাঁর একা এক লাগে এবং মানুষের সঙ্গও অসহ্য বোধ হয়। এই অসহ্য বোধ হওয়া ব্যাধি বাড়ছে। ক্রমেই বাড়ছে। এর মধ্যে দু’বার তাঁর মনে হয়েছে বেঁচে থাকার তেমন কোনো অর্থ নেই। সাধারণভাবে মনে হয় নি, তীব্ৰভাবেই মনে হয়েছে।
প্রথমবার মনে হলো তিন বছর আগে। রাতে খাওয়াদাওয়া করে ঘুমুতে গেছেন। রেহানা বলল, আজকের ভেজিটেবল কোপ্তা তোমার কেমন লেগেছে? তিনি বললেন, ভালো।
একটু টক টক লাগছিল না?
হুঁ।
তেঁতুল বেশি হয়ে গিয়েছিল। মাদ্রাজি রান্না তো–সব কিছুতেই তেঁতুল দেয়।
হুঁ।
আমি বাবুর্চিকে বলেছি–তেতুল ছাড়া একবার করতে।
ভালো করেছি।
কাল করতে বলব?
বল।
তিনি কোলবালিশ জড়িয়ে শুয়ে পড়লেন। বাতি নিভিয়ে রেহানা ঘুমুতে এল এবং সে কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল। তাঁর ঘুম আসছিল না। তিনি এপাশ-ওপাশ করলেন না। নড়াচড়া করলে রেহানার ঘুম ভেঙে যাবে। চুপচাপ শুয়ে রইলেন। বাথরুমের ট্যাপ বোধহয় ভালোমতো বন্ধ করা হয় নি। কিছুক্ষণ পর পর ‘টপ’ করে পানির ফোঁটা পড়ার শব্দ আসতে লাগল। এক মিনিট নীরবতা–তারপর ‘টপ’ করে একটা শব্দ। আবার নীরবতা আবার শব্দ। তিনি সাবধানে বিছানা ছেড়ে উঠলেন। বাথরুমের ট্যাপ ভালো করে বন্ধ করলেন। তখন ঘড়ির শব্দ শোনা যেতে লাগল। টক টক করে সেকেন্ডের কাঁটা নড়ছে। তিনি আবার উঠলেন। দেয়াল থেকে চেয়ারে দাঁড়িয়ে ঘড়ি নামানোর কোনো অর্থ হয় না। তিনি খানিকক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন। সামনের রাস্তা ফাঁকা। কোনো লোক চলাচল নেই। শীতের রাতে এই সময় লোক চলাচল থাকেও না। সে রাতে শীত খুব তীব্ৰ ছিল। কিন্তু তার শীত লাগিছিল না। তাঁর গায়ে ফ্লানেলের স্লিপিং স্যুট। বারান্দায় খোলা বাতাস দিচ্ছে। শীতে তাঁর জমে যাওয়ার কথা। তিনি রেলিং ধরে দাঁড়ালেন। তার একটু গরম লাগতে লাগল। সেই সঙ্গে ক্ষীণ ইচ্ছা হতে লাগল। লাফ দিয়ে নিচে পড়ে যেতে। তাঁর মনে হলো পড়াটা খুব ইন্টারেস্টিং হবে। তিনতলা থেকে নিচে পড়ার সময় মাথাটা যদি আগে পড়ে তাহলে মাথা থ্যাতলানোর টাস করে একটা শব্দ হবে। সেই শব্দটাও ইন্টারেস্টিং হবার কথা। এই জাতীয় চিন্তা সব মানুষের ভেতর কখনো না কখনো আসে, কিন্তু চিন্তাটা স্থায়ী হয় না। মুহূর্তের মধ্যে আসে আবার মুহুর্তের মধ্যে চলে যায়। তাঁর গেল না। তিনি স্থির সিদ্ধান্তে এলেন যে লাফিয়ে নিচে পড়বেন। পড়ার জন্যে ভালো জায়গা রেব করতে হবে। নরম কোনো জায়গায় পড়লে হবে না। শানবাধানো জায়গায় পড়তে হবে। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি লাফিয়ে নিচে পড়ে যাবেন এই চিন্তাটা তাঁর এত ভালো লাগতে লাগিল যে আনন্দে গায়ে কাটা দিল। তার মনে হলো-অনেক অনেক দিন তিনি এই আনন্দ পাননি। তিনি রেলিঙের ওপর উঠতে যাচ্ছেন তখন শোবার ঘরের থেকে রেহানা বলল, এই তুমি একা একা এখানে কী করছ?