মোবারক সাহেব হোটেলের বারান্দা থেকে শোবার ঘরে চলে এলেন। রেহানার সঙ্গে টেলিফোনে খানিকক্ষণ কথা বলবেন। দেশ থেকে আসা ফ্যাক্সগুলো দেখবেন। ভূতের বইটা পড়বেন। না, গোটা বই না, প্রথম গল্পের শেষটা। আজ দিনটা শুয়ে বসে কাটানো। কাল অনেক কাজ। কাজে সাহায্য করার জন্যে তিনি সঙ্গে কাউকে আনেন নি। যা করার তাকে একা করতে হবে। একজন কাউকে নিয়ে এলে হতো। কাজে সাহায্য না হোক কথা বলা যেত। মানুষ একা থাকতে পারে না। মানুষের সবচে’ বড় শাস্তি মৃত্যুদণ্ড না–সলিটারি কনফাইনমেন্ট। নিঃসঙ্গ নির্বাসন।
হ্যালো রেহানা?
ওমা, তুমি!
কেমন আছ রেহানা??
আশ্চৰ্য, তুমি ফাট করে জাপান চলে গেলে। আগে তো কিছুই বল নি। আমি ইদরিসকে টেলিফোন করলাম–ইদরিস বলল, স্যার জাপানে। আমি বললাম–কোথায় আছে টেলিফোন নাম্বার দাও। ও দিল না। বলল, সে জানে না। আমি মিশ্চিত সে জানে, তবু দিল না। তুমি কি ওকে বলেছ। আমাকে টেলিফোন নাম্বার না দিতে?
না।
তাহলে দিল না কেন?
বুঝতে পারছি না কেন দিল না।
তুমি অবশ্যই ওকে কঠিন ধমক দেবে। কী আশ্চৰ্য আমি টেলিফোন নাম্বার চাইলাম, ও দিল না। মিথ্যা কথা বলল…
রেহানা, তুমি কেমন আছ সেটা তো বললে না।
ভালো না। কাল সারারাত এক ফোটা ঘুম হয়নি। রাত এগারটার সময় ঘুমুতে গেছি তখনি মনে হয়েছে ঘুম হবে না। কান্তাকে টেলিফোন করলাম–কান্তা বলল, মাথায় পানি ঢেলে, এক কাপ গরম দুধ খেয়ে শুয়ে থাকতে। মাথায় পানি ঢালিলাম। কিন্তু গরম দুধ আর খুঁজে পাই না। চায়ের জন্যে কনডেন্সড মিস্ক ছাড়া ঘরে দুধ নেই। কল্পনা করতে পার? শেষে ডিপ ফ্রিজে এক প্যাকেট দুধ পাওয়া গেলা–জমে পাথরের মতো হয়ে গেছে। কল্পনা করতে পার? মাইক্রোওয়েভে দুধের পাথর গলাতে দিয়েছি–ওমা সেটাও নষ্ট! ঐ দুধ গরম করে খেতে খেতে রাত বেজেছে দু’টা।
গরম দুধ খাবার পরেও লাভ হয় নি? দেখেছি। শেষ রাতের দিকে চোখের পাতা একটু বন্ধ হয়েছে–তখন শুধু দুঃস্বপ্ন দেখেছি।
তোমার সেই অ্যাকসিডেন্টের দুঃস্বপ্ন?
না। আরো ভয়ংকর। স্বপ্নে দেখলাম আমার যে কাজের মেয়েটা করিমের মা, সে বঁটি দিয়ে আমাকে কোপাচ্ছে।
বল কী?
আমি যতই বলি–এই করিমের মা, এই, ততই সে হাসে আর কোপ দেয়। যাই হোক সকালে ঘুম থেকে উঠেই তিন মাসের অ্যাডভান্স বেতন দিয়ে ওকে বিদায় করেছি। যেতে চায় না–কান্নাকাটি করে–আমি পাত্তা দিই নি। এমনিতেই আমার রাতের ঘুম হয় না, তারপর যদি এরকম দুঃস্বপ্ন দেখার পরেও তাকে রেখে দেই, সেটা কি ঠিক হবে?
ना, छैिक श्रद ना।
তুমি জাপান থেকে আমার জন্যে একটা বই নিয়ে এস।
কী বই?
স্বপ্নের ইন্টারপ্রিটেশনের একটা বই। কোন স্বপ্ন দেখলে কী হয়–এই বই।
খাবনামা জাতীয় বই?
হুঁ।
এইসব বই আমাদের দেশের ফুটপাতে পাওয়া যাবার কথা। জাপানে কি পাওয়া যাবে?
তাই পাওয়া যাবে। স্বল্প নিয়ে সারা পৃথিবীতে রিসার্ট হচ্ছে। স্বপ্ন তো তুচ্ছ করার বিষয় না।
আচ্ছা আমি বই নিয়ে আসব। এখন টেলিফোনটা রাখি। জরুরি কোনো ফ্যাক্স এসেছে বলে মনে হচ্ছে। ফ্যাক্স মেশিনে শব্দ হচ্ছে।
রেহানাকে কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়ে মোবারক সাহেব টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। তিনি স্বস্তিবোধ করছেন–কারণ রেহানা তার কাছে টেলিফোন নাম্বার চায় নি। চাইতে ভুলে গেছে।
টেপীর সম্পর্কে লোকমান খোঁজ যা পাঠিয়েছে তাতে মোবারক সাহেবের বিস্ময়ের সীমা রইল না। মেয়েটির নাম টেপী নয়–মিতু। তার ছবির জগতের একটা নাম আছে–রেশমা। তারা তিন বোন না, দু’বোন এক ভাই। ভাই জেলে আছে। সাত বছরের সাজা হয়েছে। বাবা চা বাগানে চাকরি করতেন। চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসা করতে গিয়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন। মিতু ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় তিনি মারা যান। মেয়েটির আর পড়াশোনা হয় নি।
লোকমানের পাঠানো রিপোর্টটা সম্পূর্ণ না। মেয়েট ছবির লাইনে কী করে এল রিপোর্টে এই তথ্য থাকা উচিত ছিল। মেয়েটির বাবা কীসের ব্যবসা করতেন? ভাইয়ের সাত বছরের সাজা হয়েছে–মামলাটা কীসের? খুনের মামলা? অস্ত্র মামলা?
মেয়েটি অভিনয় ভালোই জানে–শুরুতে তার সামান্য সন্দেহ হচ্ছিল মেয়েটি রসিকতা করছে–শেষে তিনি মেয়েটির কথা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন। তিন বোন–হ্যাঁপী, টেপী, পেপী। এই হাস্যকর ব্যাপারটি যে-মেয়ে বিশ্বাস করিয়ে ফেলতে পারে তার অভিনয় ক্ষমতা তুচ্ছ করার মতো না।
মোবারক সাহেব দুপুরে কিছু খেলেন না। বরফের কুচি দেয়া এক গ্লাস টমেটোর রস খেয়ে শুয়ে পড়লেন। গল্পের বইটি পড়ার চেষ্টা করলেন। যতই এগুচ্ছেন গল্প ততই উদ্ভট হচ্ছে। ভূতের গল্প হিসেবে এইসব ছাইপাশ আজকাল লেখা হচ্ছে। লক্ষ লক্ষ কপি ছেপে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। কোনো মানে হয়?
ভরাপেটে আরাম করে ঘুমানো যায় না। হাঁসফাস লাগে। ক্ষিধে নিয়ে শুয়েছেন বলেই বোধহয় তিনি সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমুলেন। ঘুম ভাঙল টেলিফোনের শব্দে। অফিস থেকে টেলিফোন। তিনি যতদিন বাইরে থাকবেন ততদিনই প্রতি সন্ধ্যায় টেলিফোনে তাঁর খোঁজখবর নেয়া হবে। ঢাকা অফিসের খবর তাঁকে দেয়া হবে।
টেলিফোন করেছে লোকমান। মোবারক সাহেব কোমল গলায় বললেন, কেমন আছ লোকমান?
স্যার ভালো আছি। একটা ফ্যাক্স পাঠিয়েছিলাম স্যার, পেয়েছেন?