মিতু বিস্মিত হয়ে বলল, কী চিঠি?
আমি কী করে বলব। কী চিঠি? খামে বন্ধ। আমি খাম খুলি নি।
খাম খুলে মিতু চারটা চকচকে পাঁচ শ টাকার নোট পেল। কোনো চিঠি নেই, শুধুই টাকা। টাকাগুলো সে মোবারক সাহেবের বাড়িতে ফেলে এসেছিল।
ঝুমুর অবাক হয়ে বলল, এত টাকা কীসের আপা?
মিতু ফ্যাকাসে ভঙ্গিতে হাসল।
মোবারক সাহেবের হোটেলের ঘর
মোবারক সাহেবের হোটেলের ঘর আকাশের কাছাকাছি। একাশিতলার ৮৩৩ নম্বর রুম। জানালা খুললে রুমের ভেতর মেঘ ঢুকে পড়বে। তবে জানালা খোলার ব্যবস্থা নেই। রুমের সঙ্গে বারান্দার মতো আছে-বারান্দাও থাই এলুমিনিয়ামে ঢাকা। এখানে দাঁড়ালে টোকিও শহরের খানিকটা দেখা যায়। সবচে’ ভালো দেখা যায় ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের রানওয়ে। প্রতি মিনিটে একটা করে প্লেন উঠছে–নামছে। প্লেন যে এমন রাজকীয় ভঙ্গিতে আকাশে ওড়ে মোবারক সাহেবের ধারণা ছিল না। বেশ খানিকক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্লেনের উঠানামা দেখে এই সিদ্ধান্তে এলেন যে, উড়ার সময় প্লেনগুলো রাজকীয় ভঙ্গিতে উড়লেও নামার সময় ভয়ে ভয়ে নামে।
হোটেলে বারান্দার এই অংশটির নাম বিজনেস কর্নার। পারসোনাল কম্পিউটার, ফ্যাক্স মেশিন, লেখার চেয়ার-টেবিল সবই আছে। লেখার টেবিলের এক কোণায় কফি পার্কেলেটরে আগুনগরম কফি। মূল লেখার টেবিলের এক কোণে ছোট্ট টিভিতে সিএনএন-এর খবর দেখাচ্ছে।
বারান্দার এই অংশে সিগারেট খাওয়া যাবে। এ রকম একটা নোটিশ ঝুলছে। নো ম্মোকিং সাইন বুললে সিগারেট খাবার ইচ্ছে হয় কিন্তু সিগারেট খাওয়া যায় এ জাতীয় নোটিশ দেখলে সিগারেট খেতে ইচ্ছা করে না।
আজ রোববার। ছুটির দিন। মোবারক সাহেব কাজকর্ম যা নিয়ে এসেছেন তার কিছুই আজ করার নেই। শহরে ঘুরে বোড়ানো বা শপিং করার প্রশ্ন আসে না। একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত এইসব ভালো লাগে–তারপর ভালো লাগে না। তাছাড়া জাপানে তাঁর দেখার নতুন কিছু নেই। তিনি আরো খানিকক্ষণ প্লেনের উড়াউড়ি দেখলেন। আজ সারাদিন কী করবেন তার একটা তালিকা মনে মনে করলেন।
রেহানার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলা। কথা না বললেও হয়–বললে ক্ষতি নেই। জীবনে যতবার দেশের বাইরে এসেছেন ততবারই স্ত্রীর সঙ্গে অন্তত একবার হলেও টেলিফোনে দীর্ঘ আলাপ করেছেন। তিনি অসংখ্যবার দেশের বাইরে গেছেন–রেহানা কখনো তার সঙ্গে আসে নি। রেহানার আকাশভীতি আছে। ছোটবেলায় তার হাত দেখে কে নাকি বলেছিল তার মৃত্যু হবে অ্যাকসিডেন্টে। রেহানার ধারণা সেই অ্যাকসিডেন্ট হবে আকাশে।
রেহানাকে টেলিফোনের পর চিঠি লেখা যেতে পারে। বাইরে এলেই তাঁর চিঠি লিখতে ইচ্ছা করে। কিন্তু চিঠি লিখবে কাকে? তাঁর চিঠি লেখার কেউ নেই।
বই পড়া যায়। ভূতের বইটা সঙ্গে এনেছেন–প্রথম গল্পটা মাঝামাঝি পর্যন্ত পড়া হয়েছে। গল্পের শেষটা কেমন দেখা যেতে পারে। সুন্দর করে শুরু করা গল্পের শেষটা সাধারণত খুব এলোমেলো থাকে।
মোবারক সাহেব কাপে কফি ঢাললেন। চা-কফি এইসব পানীয় নিজে ঢেলে খেতে ভালো লাগে না। অন্য কেউ বানিয়ে হাতে তুলে দিলে ভালো লাগে। টেপী মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে এলে ভালোই হতো। এই মুহুর্তে কফির কাপ হাতে তুলে দিতে পারত। ছুটির দিন ছিল। ছুটির দিনে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতেন। যা দেখত তাতেই বিস্ময়ে অভিভূত হত। সেই বিস্ময় দেখতে ভালো লাগত। নিজের বিস্মিত হবার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেলে অন্যের বিস্মিত চোখ দেখতে ভালো লাগে। মেয়েটিকে অনায়াসে নিয়ে আসা যেত। শেষ মুহুর্তে পরিকল্পনা বাদ দিলেন–তবে মেয়েটি সম্পর্কে খোঁজখবর লোকমানকে পাঠাতে বলেছিলেন। লোকমান ফ্যাক্স গতকাল পাঠিয়েছে। তাঁর পড়ে দেখতে ইচ্ছা করে নি। এখনো করছে না। যখন করবে। তখন পড়ে দেখবেন।
কফি খেতে ভালো হয় নি। কিংবা হয়তো ভালোই হয়েছে। তাঁর নিজের ভালো লাগছে না। ভালো লাগা এবং মন্দ লাগার ব্যাপারটা তাঁর খুব তীব্র। যা ভালো লাগে না, হাজার চেষ্টা করেও তাকে আর ভালো লাগাতে পারেন না। যখন বয়স কম ছিল তখন ভালো লাগাতে চেষ্টা করতেন। এখন তাও করেন না।
রেহানাকে বিয়ের রাতেই তাঁর ভালো লাগে নি। পুতুল পুতুল টাইপের একটা মেয়ে। আয়নায় জবরজং হয়ে খাটের এক কোণায় জড়োসড়ো হয়ে বসে ছিল। ঘরে ঢুকেই তাঁর গোলাপ ফুলের গন্ধে মাথা ঘুরে গেল। দুনিয়ার গোলাপ দিয়ে বাসরঘর সাজিয়েছে। একটা গোলাপের ঘ্রাণ সহ্য করা যায়। কিন্তু এক লক্ষ গোলাপের ঘ্রাণ সহ্য করা যায় না। তাঁকে ঢুকতে দেখেই রেহানা মুখ তুলে তাকাল। সুন্দর মুখ। গোলগাল সুখী সুখী চেহারা, বড় বড় চোখ। তারপরেও মোবারক সাহেবের ভালো লাগল না। তিনি ভালো লাগার প্রাণপণ চেষ্টা করে বললেন, কেমন আছ রেহানা?
নববধু নড়েচড়ে বসল, জবাব দিল না।
কী গরম পড়েছে দেখেছি, গরমে ফুল পচে বিশ্ৰী গন্ধ ছাড়ছে তাই না?
রেহানা বলল, জ্বি।
অথচ বাসরঘর মোটেই গরম ছিল না। শীতকালে বিয়ে হচ্ছে তারপরেও বাসরঘরের এয়ারকুলার চলছে। মাথার উপরে হালকাভাবে ফ্যান ঘুরছে। তিনি নববধূর পাশে বসে হাই তুললেন। বাসরঘরে নববধূর পাশে বসে খুব কম পুরুষই হাই তোলে। তিনি সেই কমসংখ্যক পুরুষদের দলে। রেহানা আশপাশে থাকলে এখনো তার হাই ওঠে। টেলিফোনে যখন তার সঙ্গে কথা বলেন তখনো হাই ওঠে।