আমি কাছে গেলাম। তিনি আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, গা এখনও খানিকটা গরম। তখন বড় মামা আমার মাথায় হাত দিলেন। মামা বললেন, নাহ জুর নেমে গেছে।
বাবা বললেন, তোর মা ঘাটে বসে আছে। মাকে ডেকে নিয়ে আয়। চা খাব।
আমি অবাক হয়ে ঘাটের দিকে যাচ্ছি। এখন আর মনে হচ্ছে না আমি স্বপ্ন দেখছি। এখন মনে হচ্ছে মায়ের মৃত্যুর ব্যাপারটা ছিল স্বপ্ন। এখন যা দেখছি সেটাই বাস্তব। মা মারা যাননি। বেঁচে আছেন।
ঘাটে মা না, ললিত ছিপ হাতে বসে আছে। সে আমাকে দেখে মায়ের মতো করে মিষ্টি গলায় বলল, আমার বাবুটার জ্বর কমেছে? দেখি দেখি জ্বরটা দেখি।
আমাকে তার কাছে যেতে হলো না। সে এসে কপালে হাত রেখে আনন্দিত গলায় বলল, শরীর গাঙের পানির মতো ঠাণ্ডা। জ্বর নাই! আমার বাবুর জ্বর নাই নাই রে। তাইরে নাইরে না রে।
আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। মাথার ভেতরটা তখন পুরোপুরি এলোমেলো। সব তালগোল পাকিয়ে গেছে। ঘটনা কিছুই বুঝতে পারছি না। একবার মনে হলো এক্ষুনি মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব। শরীর কেমন জানি করছে। প্রচণ্ড পিপাসা হচ্ছে। ললিতা হাত ধরে টেনে তার পাশে আমাকে বসাল। পানিতে বড়শি ফেলে গানের সুরে বলতে লাগল–
নাই নাই নাই
বাবুর জ্বর নাই।
দীঘির জলে বড়শি ফেলি
বিশাল মাছ পাই।
সেদিনের অভিজ্ঞতা আপনাকে ঠিকমতো গুছিয়ে বলতে পারছি না। তা সম্ভবও না। আপনি লেখক মানুষ। লেখকদের কল্পনাশক্তি প্রবল হয় বলে শুনেছি। আপনি কল্পনা করে নিন। জলের মাছ ডাঙ্গায় বাস করতে এলে যা হয়, তাই। কিংবা ডাঙ্গার কোনো প্রাণীকে হঠাৎ জলে বাস করতে দিলে যা হয়।
আমি ললিতার পাশ থেকে উঠে দাঁড়ালাম। ঘরের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। ললিতা পেছন থেকে ডাকল, এই বাবু যাস কই। একটু বস না! মার সাথে কিছুক্ষণ বসলে কি হয়?
আমি ফিরেও তাকালাম না। বাবার সামনে দিয়ে ঘরে ঢুকে গেলাম। বাবা তখনও মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পাঁচালি পড়ছেন।
বেদনায় মৌন মূক বাক্য নাহি স্বরে
চুক্ষ মেলি লোকনাথ চাহে ধীরে ধীরে।
একতলায় ঢুকে ঝাঁটার শব্দ পেলাম। বাড়ির সম্মুখ বারান্দা কে যেন ঝাট দিচ্ছে। আমি গেলাম সেখানে। মা বারান্দা ঝাট দিচ্ছেন। মার শাড়িটা মলিন, মুখ মলিন। আমি চাপা গলায় ডাকলাম, মা!
মা চমকে ফিরে তাকালেন। হাসলেন। ঝাঁটা ফেলে আমাকে জড়িয়ে ধরে প্রায় ফিসফিস করে বললেন, পেরায়ই তুমি আমারে মা ডাকো। কেন ডাকো বাবু? তোমার মা কোনোদিন জানলে মনে বেজায় কষ্ট পাইব। আমি তো তোমার মা না। দাসীরে মা ডাকতে হয় না। তয় বাবু, তুমি যখন মা বইল্যা ডাক দেও, আমার কইলজা জুড়ায়া যায়।
হিন্দুরা জন্মান্তরে বিশ্বাস করে। ছোটবেলা থেকে আমরা এই বিষয়ের গল্পগাথা শুনি। জাতিশ্বর বালকের গল্প, যার পূর্বজন্মের স্মৃতি আছে–এসব।
আমার মনে হলো, এ গ্রনের কিছু আমার হয়েছে। আমি আবার নতুন করে পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছি। তবে পূর্বজন্মের স্মৃতি আমার আছে। আগের জগতের চেয়ে নতুন এই জগ সম্পূর্ণই আলাদী।
দিন সাতেক পার হওয়ার পর আমি যা বুঝলাম তা হলো আমার এই বাবা অতি ভালো মানুষ ধর্মকর্ম নিয়ে থাকেন। আমাদের বাড়িটা ঠাকুর্দা বানিয়ে দিয়ে গেছেন। বড় মামা আমাদের সঙ্গে থাকেন। কাজকর্ম কিছু করেন না। তার একটা ফার্মেন্স আছে। ফার্মেসির নাম ললিতা আরোগ্য বিতান। সেই ফার্মেসি কর্মচারী চালায়। বড় মামা বেশিরভাগ সময় ঘরেই থাকেন।
আমাদের দাসী (আমার মা) অনেক দিন থেকেই এই বাড়িতে আছে। সে লেখাপড়া জানে। তাকে প্রায়ই দেখা যায় কুয়াতলায় বলে পকিয়ে লুকিয়ে বই পড়ছে।
সব মিলিয়ে আমাদের অতি মুখের এক সংসার। একটাই শুধু কষ্ট। আমার মা এখানে দাসী আমার এটাই মূল গল্প। আপনার মতামত শোনার পর আরও কিছু বলব।
নলিনী বাবু থামলেন একনাগাড়ে কথা বলে তিনি খানিকটা ক্লান্তও হয়েছেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি ধূমপান করি না। কিন্তু কেন জানি ধূমপান করতে ইচ্ছা হচ্ছে।
আমি সিগারেটের প্যাকেট তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, আপনি হঠাৎ নতুন এক জগতে ঢুকে গেলেন। এই বিষয়ে কারো সঙ্গে কথা বলেছেন?
বড় মামাকে বলেছি। তিনি সব শুনে বলেছেন, টাইফয়েড় হবার কারণে এইসব তোর মনে হচ্ছে। টাইফয়েড় খারাপ রোগ। এতে অঙ্গহানি হয়। মাথার গোলমাল হয়। ভিটামিন খেতে হবে। কড লিভার ওয়েল খেতে হবে।
বড় মামা আমাকে তার ফার্মেসি থেকে ভিটামিন আর কড লিভার ওয়েল ক্যাপসুল এনে দেন।
নতুন জগতে আপনি কতদিন ছিলেন?
তিনি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, তিন বছর।
আমি বললাম, হঠাৎ একদিন আগের জায়গায় ফিরে এলেন?
এসে কি দেখেন এখানেও তিন বছর পার হয়েছে?
হা। মঙ্গলবার সকাল নটার সময় ঘটনাটা ঘটে। আমি আগের অবস্থায় ফিরে গিয়ে দেখি সকাল নটা বাজে। মঙ্গলবার। চৈত্র মাস।
আপনার পোশাক কি একই ছিল?
না।
আমি বললাম, আপনার এক পরিবেশ থেকে আরেক পরিবেশের ট্রানজিশানের ঘটনাটা বলুন।
নলিনী বাবু বললেন, স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি, তখন ললিতা অর্থাৎ ওই জগতে আমার মা বলল, বাবু স্কুলে আজ না গেলি। তোর গা গরম। মনে হয় জ্বর আসছে। শুয়ে থাক। আমি বললাম, আচ্ছা। চাদর গায়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলাম। সে বসল আমার মাথার পাশে। ফুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল, বাবু তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
আমি বললাম, করো।
দাসী মেয়েটাকে তুই মা ডাকিস কি জন্য? আমি নিজেও কয়েকবার শুনেছি। ছিঃ বাবা ছিঃ আমি কি তোকে কম আদর করি? বাইরের কেউ শুনলে নোংরা অর্থ করবে। করবে না?