আমি জিভে লবণ ছোঁয়ালাম।
শুরু করবেন উচ্ছে ভাজা দিয়ে। গরম পানি দিয়ে উচ্ছে ধুয়ে এনেছি এতে তিক্ত স্বাদ কম লাগবে। তবে তিক্ত স্বাদ দরকার। আপনি কি জানেন বিষের স্বাদ তিক্ত।
জানি। মানুষ যেন বিষাক্ত ফল না খায় এই জন্যেই প্রকৃতি বিষাক্ত ফল এবং খাবারের স্বাদ তিতা করেছে।
নলিনী বাবু বললেন, আমাদের শরীরেও বিষ আছে। করলার তিতা শরীরে যাওয়ায় বিষে বিষক্ষয় হবে।
আমি করলা খেলাম।
এটা হলো সজনে পাতার ভাজি। সজনে পাতাও শরীরের বিষ দূর করে। খেতে কেমন হয়েছে বলুন।
অসাধারণ হয়েছে। সজনে পাতা যে খাওয়া যায় এটাই জানতাম না।
পরের আইটেম রসুন ভর্তা। রসুন এবং কাঁচা মরিচ ভাপে সিদ্ধ করে চটকানো।
রসুন ভর্তা কোন উপকারে আসবে?
খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে শরীরে অনেক ভারী ধাতু ঢুকে যায়। নিশ্বাসের সঙ্গে ঢুকে সীসা। নদীর মাছের সঙ্গেও অনেক ভারী ধাতু শরীরে ঢুকে। রসুন এই ভারী ধাতুগুলি প্রস্রাবের সঙ্গে বের করে দেয়।
আমি বললাম, এই তথ্য কেমিস্ট্রির ছাত্র হিসাবে আমার জানা। আপনি কোথেকে জেনেছেন।
এক আয়ুর্বেদের কাছ থেকে জেনেছি। উনার নাম শ্রীযুক্ত হরেন্দ্রচন্দ্র আচার্য। ব্যাকরণ তীর্থশাস্ত্রী।
নেক্সট আইটেম।
এটা হলো মূল খাবার খেয়ে বলুন কি?
প্রথমে মনে হলো আলু। হালকা হলুদ ঝোলে আলুর মতোই দেখা যাচ্ছে। মুখে দেয়ার পর বুঝলাম আলু না, পেঁপে। আলুর মতো গোল করে কেটে রান্না করা হয়েছে। খেতে অসাধারণ।
নলিনী বাবু বললেন, পেঁপে আপনার শরীরকে স্নিগ্ধ করবে। পাকস্থলী বলবান করবে। এর পরে খাবেন টক। অনেকে বলে খাট্টা। স্যুপের মতো চুমুক দিয়ে খাবেন। এই অস্ত্র শরীরের এসিডকে নিউট্টলাইজ করবে।
ডাল নেই?
না। ডাল কিডনির জন্য ভালো না। শেষ করবেন পায়েস দিয়ে। লবণ দিয়ে শুরু চিনি দিয়ে শেষ। খেয়ে তৃপ্তি পাচ্ছেন?
পাচ্ছি। ভাত আরেকটু নিতে পারলে ভালো হতো।
ভাত আর নিতে পারবেন না। পাকস্থলীর অর্ধেক খালি রাখতে হবে।
শরীর শুদ্ধি করে আরামের ঘুম দিলাম। ঘুম ভাঙল ঠিক আগের দিনের মতো সন্ধ্যাবেলা। তবে অজি বৃষ্টি নেই।
বসার ঘরে সোফায় বসে নলিনী বাবু নিবিষ্ট মনে কি যেন লিখছেন। আমি বললাম, কি লিখছেন।
নলিনী বাবু বললেন, সংস্কৃত শ্লোক। যে কয়টা মনে পড়েছে লিখে যাচ্ছি। হয়তো আপনার কাজে লাগবে।
আমি চোখ বুলালাম। নম্বর দিয়ে বেশ গুছিয়ে লেখা।
উদাহরণ
১. পঙ্কো হি নভমি ক্ষিপ্তঃ
ক্ষেপ্তঃ পতনি মূর্ধতি।
(কাদা উপরে ছুড়লে, যে ছুড়ে তার মাথায় এসে পড়ে।)
২. পঞ্চভি মিলিতৈঃ কিং যদ্দো গতিহ ন সাধ্যতে।
(পাঁচজন মিলে কাজ করলে জগতের সব কার্য সিদ্ধ হয়।)
৩. কো ন যাতি বশং লোকঃ মুখে পিন্ধ্রেন পুরিতঃ।
(মুখে অন্ন তুলে দিলে কোন ব্যক্তি না বশীভূত হয়?)
সন্ধ্যা পুরোপুরি মিলাবার পর নলিনী বাবু আমাকে নিয়ে বারান্দায় বসলেন। বারান্দার বাতি নেভানো। ঘরের ভেতর থেকে আলো আসছে। নলিনী বাবু পান মুখে দিতে দিতে বললেন, মায়ের মৃত্যু পর্যন্ত আপনাকে বলেছি। এর পর থেকে শুরু করি?
আমি বললাম, করুন।
মায়ের মৃত্যুর পর ব্রাহ্মণ পুত্রকে কঠিন শোক পালন করতে হয়। আপনি কতটুকু জানেন আমি জানি না, একটু বলে নেই। ১৩ দিন পর্যন্ত হবিষ্যান্ন খেতে হয়। দিনে এক বেলা আহার। এক মুঠো আতপ চালের ভাত, কাঁচকলা সিদ্ধ, এক চামুচ গব্যঘৃত। সাধারণ লবণ খাবারে দেওয়া যাবে না। দিতে হবে সৈন্ধব লবণ। রান্না নিজেকে করতে হবে। রান্নায় খড়ি ব্যবহার করা যাবে না। শুকনা পাতায় রাঁধতে হবে। খেতে হবে আঙট পাতায়। আঙুট পাতা কি জানেন?
না।
আঙট পাতা হলো কলাপাতা। এই তের দিন কোনো চেয়ারে বসা যাবে। খাটে শোয়া যাবে না। কুশাসন বা মৃগচর্ম ব্যবহার করা যেতে পারে। সূর্য ডুবে যাওয়ার পর ফল ছাড়া কিছুই খাওয়া যাবে না।
১৩ দিন পার হওয়ার পর হবে নিয়ম ভঙ্গ অনুষ্ঠান। তখন নাপিত এসে মাথা, ভুরু সব কামিয়ে দেবে। সেলাই ছাড়া এক টুকরা নতুন কাপড় পরিয়ে দেবে।
আমার বয়স কম তারপরও আমাকে নিয়মমতো শোক পালন করতে হলো। নিয়ম ভঙ্গ অনুষ্ঠানের শেষে নিজের ঘরে ঢুকে মেঝেতে শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল পাঁচালি পাঠের আওয়াজে। বাবার গলা–তিনি সুর করে পাঁচালি পাঠ করছেন। বাবাকে আমি কখনও পাঁচালি পাঠ করতে শুনিনি। মা পাঠ করতেন। বাবা বলতেন, কানের কাছে ঘ্যানঘ্যানানি করবা না। নীরবে পড়।
আমি অবাক হয়ে উঠে বসলাম। কিছুক্ষণ বাবার পাঁচালি পাঠ শুনলাম।
সেদিন উনিশে জ্যৈষ্ঠ আর রবিবার
সকালে হয়েছে খোলা মন্দিরের দ্বার।
রামকুমার, চন্দ্র ভট্টাচার্য দুজনে
বাবার মন্দিরে আসি প্রণাম চরণে…
পাঁচালি শুনতে শুনতেই হঠাৎ লক্ষ করলাম আমার গায়ে সেলাই ছাড়া নতুন কাপড় না। সাধারণ কাপড়। মাথায় হাত দিয়ে দেখি মাথাভর্তি চুল। প্রথম প্রশ্ন মাথায় এলো, আমি কি স্বপ্ন দেখছি? অবশ্যই স্বপ্ন। আমার মাথা কামানো হয়েছে। মাথাভর্তি চুল থাকার কোনোই কারণ নাই।
আমি ঘর থেকে বের হলাম। দোতলা থেকে নামলাম।
বাবা কুয়াতলায় বসে পাঁচালি পড়ছেন। তার সামনে বড় মামা বসে আছেন। তিনি আগ্রহ নিয়ে পাঠ শুনছেন। বড় মামা তো চলে গেছেন। আবার কখন এসেছেন? বাবা আমাকে দেখেই হাত ইশারা করে কাছে ডাকলেন। নরম গলায় বললেন, বাবা! জ্বর কি কমেছে?
আমি কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইলাম। বাবা বললেন, কাছে আয় জ্বর দেখি।