বইটার নাম কী?
নিষাদ। কাহিনী কি আপনার মন আছে, না ভুলে গেছেন?
মনে আছে। আপনার কাহিনী কী?
বলা শুরু করব?
হ্যাঁ, শুরু করুন।
বিরক্ত হবেন না তো?
বিরক্ত তো হবই। লেখকরা নিজেরা গল্প তৈরি করেন। অন্যদের গল্প শুনে আনন্দ পান না।
বৃষ্টির ছাট আসছে। আপনি এখানেই বসবেন নাকি ভেতরে যাবেন?
এখানেই বসব।
নলিনী বাবু গল্প শুরু করলেন।
গম্ভীর গলায় বললেন, আমি এই জগতের অতি দুঃখী মানুষদের একজন। আবার অতি সুখী মানুষদেরও একজন।
আমি বললাম, আপনার গল্পের শুরুটা ভালো। আপনি একনাগাড়ে বলে যান। আমি আপনাকে মাঝখানে থামাব না। হুঁ দেব না। তারপর কী হলো বলব না, আপনি কথা বলে যাবেন নিজের মতো।
ধন্যবাদ।
গল্প শুরু করার আগে সামান্য বেয়াদবি করব। নিষাদ বইটি নামকরণের কোনো সার্থকতা আমি খুঁজে পাইনি।
সব কিছুর সার্থকতা খোঁজার প্রয়োজন কি আছে?
আছে। নিষাদ নাম শ্লোকে প্রথম ব্যবহার করেন বাল্মীকি।
মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং তমগমঃ শাশ্বতীঃ খমাঃ।
যৎ ক্রৌনৎঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্ ॥
এর অর্থ নিষাদ, তুই চিরকাল প্রতিষ্ঠা লাভ করবি না, কারণ তুই ক্রৌঞ্চ মিথুনের একটিকে কামমোহিত অবস্থায় বধ করেছিস।
রামায়ণের গল্প থাকুক। নিজের গল্প শুরু করুন।
নলিনী বাবু গল্প শুরু করলেন।
বাবার নাম শ্রীকান্ত ভট্টাচার্য
আমার বাবার নাম শ্রীকান্ত ভট্টাচার্য।
তিনি ময়মনসিংহ জজকোর্টের পেশকার ছিলেন। অসৎ উপায়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন। একজন পুরুষ মানুষের যত রকম খারাপ অভ্যাস থাকা সম্ভব সবই তার ছিল। মদ-গাঁজা খেতেন, আফিম খেতেন। ললিতা নামে অল্প বয়সী এক মেয়েকে রক্ষিতা হিসেবে রেখেছিলেন। মাসে একবার খারাপ পাড়ায় যেতেন রুচি বদলাবার জন্যে। ললিতা ছাড়া দশ-এগারো বছরের একটি বালকও তার সঙ্গে থাকত। তার হাত-পা টিপে দিত। বালকের নাম সুরুজ। এই বালকের সঙ্গেও তার শারীরিক সম্পর্ক ছিল। আমি কি বাবার বিষয়ে সম্পূর্ণ চিত্র আপনাকে দিতে পেরেছি?
পেরেছেন।
একটি সংস্কৃত শ্লোক বাবার চরিত্র পুরোপুরি ব্যাখ্যা করে। যদি অনুমতি দেন শ্লোকটি বলি?
বলুন।
যথা নিযুক্তোহস্মি তথা করোমি জানামি
ধর্মং ন চ মে প্রবৃত্তি।
জানাম্যধমং ন চ মে নিবৃত্তিঃ ॥
এর অর্থ ধর্ম কি তা আমি জানি, কিন্তু তাহাতে আমার প্রবৃত্তি হয় না। অধর্ম কি তাহাও আমি জানি, তাহা হইতে আমি নিবৃত্ত হইতে পারি না।
শ্লোকটা সুন্দর, আমাকে লিখে দিয়ে যাবেন।
অবশ্যই লিখে দিয়ে যাব। আমি সুন্দর সুন্দর শ্লোক জানি, একটা বড় খাতায় সব লিখে দিয়ে যাব। আপনি প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবেন। এখন বাবার চেহারার বর্ণনা দেব? আপনি লেখক মানুষ। লেখকদের কাছে চেহারার বর্ণনা গুরুত্বপূর্ণ।
চেহারার বর্ণনা দিন।
সুন্দরের বর্ণনায় আমরা রাজপুত্র শব্দটি ব্যবহার করি। বাবা ছিলেন রাজপুত্রদের রাজপুত্র। গাত্রবর্ণ গৌর। মাথা ভর্তি কুঁড়ানো চুল। বড় বড় চোখ। বাল্মীকি রামের শরীরের যে বর্ণনা দিয়েছেন বাবার সঙ্গে তার মিল আছে।–তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সুষম ও সুবিন্যস্ত, বর্ণ স্নিগ্ধ, তিনি আয়াত নেত্র, লক্ষ্মীবান ও শুভ লক্ষণযুক্ত।
ইন্টারেস্টিং।
বাবা ময়মনসিংহ শহরে থাকতেন। মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার রাতে নীলগঞ্জ আসতেন। ললিতা মেয়েটাকে নিয়ে আসতেন। দুদিন থেকে রোববার ভোরে চলে যেতেন। এই দুদিন আমি এবং মা আতঙ্কে অস্থির হয়ে থাকতাম।
আমার মায়ের নাম বুকুল বালা সাধারণত দেখা যায় স্বামী রূপবান হলে স্ত্রী রূপবতী হন না। মার ক্ষেত্রে ঘটনা তা হয়নি। আমার মার মতো রূপবতী সচরাচর দেখা যায় না।
বাবা-মা পাশাপাশি দাঁড়ালে মনে হতো রাজপুত্র-রাজকন্য। তবে মায়ের গাত্রবর্ণ ছিল শ্যামলা। আমি মায়ের গাত্রবর্ণ পেয়েছি। মা ছিলেন স্বল্পভাষী তরুণী। তার প্রধান শখ গল্পের বই পড়তে পড়তে চোখের পানি ফেলা। বিয়ের সময় তিনি ট্রাংক ভর্তি করে বই নিয়ে এসেছিলেন। আমায বিভিন্ন লেখকের একটা একটা করে বই পড়েছি, মার কাছ থেকে নিয়ে পড়েছি। শুধু আপনার বইটা পড়েছি অনেক পরে। আমাদের স্কুলের এক ছাত্রীর কাছ থেকে ধার করে পড়েছি। ছাত্রীর নাম সুলতানা বেগম। দশম শ্রেণী, বিজ্ঞান শাখা। রোল দুই অতি ভালো মেয়ে।
যে কথা বলছিলাম, দুদিনের জন্য এসে বাবা গজব করে ফেলতেন। মা বাবাকে ভয় পেতেন যমের মতো। প্রায়ই দেখেছি, মা বাবার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, কোনো কারণ ছাড়াই ভয়ে থরথর করে কাঁপছেন। বাবা হয়তো বললেন, বকুল বালা ভালো আছ?
মার মুখে কথা আটকে যেত। ভালো আছি বলতেও তার অনেক সময় লাগত।
ললিতা মেয়েটা দুটি দিন খুবই আনন্দে কাটাতো। কুয়াতলাটা তার পছন্দের জায়গা ছিল। বেশিরভাগ সময় সে কুয়াতলায় বসে পায়ে আলতা দিত। চুল আঁচড়াত। মাথায় তেল দিত। তার মুখ থাকত হাসি হাসি। আমার সঙ্গে তার টুকটাক কথাও হতো। ছিপ ফেলে মাছ মারায় তার শখ ছিল। তার জন্য ছিপ, মাছের আধার কেঁচো জোগাড় করে রাখতে হতো। মাছ মারা হতো আমাদের পুকুরেই। বাবা তার অসৎ পয়সায় নীলগঞ্জে দোতলা দালান করেছেন। বাড়ির পেছনে বিশাল পুকুর কাটিয়েছেন। ঘাট বাঁধিয়েছেন।
মাছ মারার সময় ললিতার সঙ্গে আমাকে থাকতে হতো। আমার মা চাইতেন না আমি ললিতার সঙ্গে মিশি। আমি মার কাছে ভাব করতাম ললিতাকে পছন্দ করি না। সে ডাকলে যেতে চাই না। শুধু বাবার ভয়ে না করতে পারছি না। পুকুরে ছিপ ফেলে ললিতা নানা গল্প নিজের মনেই করত। যেমন একদিন বলল, টাকি মাছের জন্ম কি জন্য হয়েছে জানিস?