আপনার যুক্তি ভালো, মিসির আলি সাহেবের মতো। ডায়েরির ব্যাপারটা বলবেন?
আমি বললাম, ডায়েরির ব্যাপারটায় কিছু রহস্য অবশ্যই আছে। ডায়েরি আপনারই লেখা এতে সন্দেহ নেই। এই ডায়েরি অন্য জগৎ থেকে এখানে চলে এসেছে তা হতেই পারে না। কোয়ান্টাম মেকানিক্স দুই জগৎ বা অসংখ জগৎ স্বীকার করে তবে এক জগতের বস্তু অন্য জগতে স্থানান্তর স্বীকার করে না। স্থানান্তর মানেই ওয়েভ ফাংশনের কলাপস। জগতের বিলুপ্তি।
নলিনী বাবু বললেন, ডায়েরিতে লেখা আমার মায়ের কিছু শোক আমি জানি। বাকি কিছুই জানি না। এটা আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে। নস্ট্রডেমামের নাম প্রথম শুনেছি।
আমি আপনার কথা বিশ্বাস করছি? ___(?)___ বলে একটা ব্যাপার আছে। মানুষের মধ্যে প্রবল ঘোর তৈরি হয় তখন সে এই ঘোরের মধ্যে শেখে। ঘোর তৈরির কারণ অজানা।
নলিনি বাবু বললেন, ডায়েরির ব্যাপারটা নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। মূর্খের ভাবনা গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। আপনাকে বলব?
অবশ্যই বলবেন।
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে প্রতিটি জগতে আমার শরীর আলাদা। আমি যখন এক জগৎ থেকে আরেক জগতে যাই তখন আমার শরীর যায় না। আমার চিন্তাটা যায়। স্মৃতিটা যায়।
আমি বললাম, আপনার এই চিন্তা খুব পরিষ্কার চিন্তা। আমাদের শরীর হলো কম্পিউটারের হার্ড ডিস্ক। চিন্তাটা হলো সফটওয়ার। কোনো অদ্ভুত ব্যাখ্যাতিত কারণে হয়তো দুই জগতের সফটওয়ার ওভার লেপিং হচ্ছে। আপনি ডায়েরি লিখছেন ঠিকই কিন্তু তখন সফটওয়ার বা আপনার চিন্তা এবং স্মৃতি অন্য জগতে। সেই জগতের মানুষটা স্মৃতি কি তা জানতে প্রবল আগ্রহী বলেই স্মৃতি বিষয়ক নানান কথাই ডায়েরিতে এসেছে।
নলিনী বাবু বললেন, আপনার ব্যাখ্যায় চমৎকৃত হয়েছি। চলুন ঘরে যাই, আকাশের অবস্থা ভালো না। বৃষ্টি নামবে। আপনার কি মনে আছে প্রথম যখন আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল তখন প্রবল বর্ষণ হয়েছে।
মনে আছে।
নলিনী বাবু অন্যমনস্ক গলায় বললেন, অন্য জগতেও আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তখনও প্রবল বর্ষণ হচিছল। দেখা হয়েছিল উত্তরার সেই বাড়িতেই।
কী দেখেছিলেন বলুন।
নলিনী বাবু বিড়বিড় করে বলেন, আমি জানি সবই আমার অসুস্থ মস্তিকের কল্পনা। তারপরও বলি। আপনার সঙ্গে রাজপুত্রের মতো একটা ছেলে ছিল। বয়স সাত-আট বছর। আমি তাকে বললাম, বাবা তোমার নাম কী? সে বলল, রাশেদ হুমায়ূন। আপনি আমাকে বললেন, আমার এই ছেলেটা জন্মের পর খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ডাক্তাররা বহু কষ্টে তার জীবন রক্ষা করেন।
আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি। জন্মের পরপর রাশেদ হুমায়ুনের মৃত্যুর ব্যাপারটা তার জানার কথা না। তারপরও ধরে নিলাম এই তথ্য তিনি সংগ্রহ করেছেন।
আমি বললাম, আর কিছু মনে আছে?
নলিনী বাবু বললেন, আপনি আপনার পুত্রকে নিয়ে একটা ছড়া বলেছিলেন। আপনার পুত্র তাতে খুব মজা পাচ্ছিল।
ছড়াটা মনে আছে?
হ্যাঁ।
বলুন শুনি।
নলিনী বাবু ছড়া আবৃত্তি করলেন।
রাশেদ বাবাটিং
দরজা বন্ধ করছিং
আমি বই পড়ছিং
এবং মজা পাচ্ছিং।
আমি দীর্ঘ সময় নলিনী বাবুর দিকে তাকিয়ে রইলাম। কোনোভাবেই এই ছড়া তার জানার কথা না।
হঠাৎ প্রবল আনন্দে আমি অভিভূত হলাম। আমার ছোট্ট বাবা রাশেদ হারিয়ে যায়নি। অন্য একটা জগতে সে তার বাবার সঙ্গেই বাস করছে।*
———-
*নলিনী বাবু আমাকে কিছু না জানিয়ে নিজে নিজেই ক্লিনিকে ভর্তি হন। তার মৃত্যু হয় সেখানেই।