আমি বললাম, শুনি আপনার ক্লিনিকে ফিরে যাবার কারণ এবং যুক্তি।
নলিনী বাবু শান্ত গলায় বললেন, ওরা সেখানে আমাকে কড়া ঘুমের অষুধ দেয়, কঠিন কঠিন ড্রাগ খাওয়ায়, এতে আমার ঘোরের মতো হয়। খুব সহজেই এক জগৎ থেকে আরেক জগতে যেতে পারি। কত জগৎ যে দেখেছি। আহারে! একটা জগৎ দেখলাম নীল পাতার গাছের জগৎ। গাছের কাণ্ডও নীল, পাতাও নীল। আমাদের আকাশ নীল। সেখানের আকাশ ঘন কালো। সূর্য দুটা। একটা প্রকাণ্ড, একটা ছোট। আমাদের সূর্যের দিকে তাকানো যায় না। ওদের সূর্যের দিকে তাকানো যায়। ছোট সূর্যটা বড়টার চারদিকে ঘুরছে।
ঐ জগতে আপনি একাই ছিলেন না-কি আরো কেউ ছিল?
শুধু আমরা দুজন।
আপনারা দুজন মানে কি? আপনি আর কে?
নলিনী বাবু জবাব না দিয়ে টেলিস্কোপ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। আমি বললাম, আপনি আর সীতা?
নলিনী বাবু নিচু গলায় বললেন, আমি আর সুলতানা। আমার ছাত্রী। ক্লাস টেন। বিজ্ঞান বিভাগ। আমি বললাম, আর কোন জগতে গেছেন। সেটা শুনি।
অল্প সময়ের জন্য পুরোপুরি পানির একটা জগৎ দেখেছি। পানিতে ছোট ছোট দ্বীপ। প্রতিটি দ্বীপে দুজন করে মানুষের থাকার ব্যবস্থা। নারিকেল গাছের মতো গাছে দ্বীপ ভর্তি। তবে গাছগুলি ছোট ছোট। নারিকেলের মতো ফুল ফুলে আছে। হাত দিয়ে পাড়া যায়।
ফল খেয়ে দেখেছেন?
আমি খাইনি, সে খেয়ে দেখেছে।
সুলতানা খেয়ে দেখেছে?
হুঁ। বলেছে ফলের পানিটা টক টক আর শাঁস অসম্ভব মিষ্টি।
আমি হতাশ গলায় বললাম, আপনি যা দেখেছেন সবই তো Drug induced hallucination. আপনার শুরুর গল্প কিছুটা হজম করা যায়। আপনার দুটা মাত্র জগৎ। একটা থেকে আরেকটায় যাচ্ছেন। এখনকার গল্প হজম করার কোনো কারণ নেই।
আপনাকে হজম করতে বলছি না। হতে পারে যা দেখছি সবই মিথ্যা কিন্তু আমি আনন্দ পাচ্ছি। এক জগৎ থেকে আরেক জগতে যাচ্ছি। কিছু সময় পানির নিচের জগতে ছিলাম। সেটা বলব?
না।
দয়া করে শুনুন। ঐ জগতে মানুষ থাকে পানির নিচে। বাস করে মাছের মতো। তারা ঝাঁক বেঁধে ঘুরে। ঘুরে বলা ঠিক না। সবসময় স্রোতের বিপরীতে সাঁতরাতে হয়। এই যাত্রা স্রোতের উৎসের সন্ধানে যাত্রা।
আপনি যে ঝকে ছিলেন, সেই ঝকে নিশ্চয়ই সুলতানা মেয়েটাও আছে।
হুঁ! আমার ধারণা হচ্ছে আপনি আমার কথা শুনে খুবই বিরক্ত হচ্ছেন।
আমি বললাম, আপনার ধারণা সঠিক। যথেষ্টই বিরক্ত হচ্ছি। আপনি প্রলাপ বকছেন। অন্যের প্রলাপ যে শুনবে সে তো বিরক্তই হবে।
নলিনী বাবু বললেন, থাক আর কিছু বলব না। আমি বললাম, সুলতানা মেয়েটির সঙ্গে আপনার প্রণয়ের অংশটি আপনি বলেননি। ঐ অংশটি শুনতে চাচ্ছি। বলতে কি আপত্তি আছে?
আপত্তি নাই। কিঞ্চিৎ লজ্জা বোধ করছি।
আমি বললাম, অন্ধকার হলো লজ্জাহর। অন্ধকার লজ্জা হরণ করে। আপনি তারা দেখতে দেখতে এই অংশটা বলুন।
নলিনী বাবু বড় করে নিশ্বাস নিয়ে গল্প শুরু করলেন, গ্রামের স্কুলের মেয়েরা মধ্যম মানের ছাত্রী হয়ে থাকে। সুলতানা তার ব্যতিক্রম ছিল। শান্ত চেহারার অতি লাজুক এক মেয়ে। চোখে চোখ পড়লে তৎক্ষণাৎ চোখ নামিয়ে নিত। ক্লাসে আসত শাড়ি পরে। শাড়ির উপর চাদর। চাদরে মাথা ঢাকা। আমি আপনাকে আগেই বলেছি ক্লাসে আমি রসিকতা করতাম। সবাই হাসত, এই মেয়েটা কখনো হাসত না। সে একমাত্র মেয়ে যে প্রশ্নের উত্তর দিত না। পরে শুনলাম সে শুধু আমার প্রশ্নেরই উত্তর দেয় না। অন্য শিক্ষকদের প্রশ্নের উত্তর ঠিকই দেয়। আমি ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারলাম না।
এক মাঘ মাসের কথা। আমি জ্বরে পড়েছি। ভালো জ্বর। ডাক্তাররা আশঙ্কা করছেন নিউমোনিয়া। ঘরে পড়ে আছি। চিকিৎসা চলছে। রোগ আরোগ্য হচ্ছে না। বরং বাড়ছে।
আমার শরীর খুব খারাপ করেছে। নিশ্বাসের কষ্ট শুরু হয়েছে। চোখ বন্ধ করে পড়ে আছি। হঠাৎ ঠাণ্ডা একটা হাত কপাল স্পর্শ করল। হাতে লেবুর গন্ধ। আমি চমকে তাকালাম। অবাক হয়ে দেখি সুলতানা। আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখেও সে হাত সরিয়ে নিল না। আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি।
সুলতানা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
আমি বললাম, একা এসেছ? কেউ কি জানে তুমি এসেছ?
সুলতানা ক্ষীণ গলায় বলল, কেউ জানে না।
আমি বললাম, করেছি কি, যাও তাড়াতাড়ি বাসায় যাও।
সে বলল, স্যার আমি যাব না।
কেন যাবে না?
সুলতানা ফুঁপিয়ে কাঁদলে থাকল। এই আমার তার সঙ্গে শেষ দেখা। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার বাসা থেকে তার বাবা আর তার ভাই এসে তাকে নিয়ে গেল। প্রায় জোর করে তাকে নেওয়া হলো। তার স্কুলের পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়া হলো। তাকে পাঠিয়ে দেয়া হলো কুমিল্লায়।
নলিনী বাবু চুপ করলেন। আমি বললাম, আপনি যখন দুঃখ জগৎ থেকে সুখ জগতে যান তখন কি সুলতানাকে দেখেন?
হ্যাঁ।
কি ভাবে দেখেন?
স্ত্রী হিসেবে দেখি। সেখানে তার নাম সীতা। সে আমার স্ত্রী।
আমি বললাম, নলিনী বাবু আপনার বিভিন্ন জগতে সুমনের পুরো ব্যাপারটা মানুষিক। বিশেষ করে ড্রাগ খেয়ে যা দেখছেন। ইচ্ছাপুরার একটা বিষয় কাজ করেছে। সুলতানার সঙ্গে জীবনযাপনের প্রবল বাসার কারনেই আপনি যে জগতে যাচ্ছেন সেখানেই সুলতানা মেয়েটিকে দেখছেন।
নলিনী বাবু বললেন, হতে পারে।
আপনি ভিন্ন ধমের মানুষ। একটি মুসলমান মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক হওয়া বেশ কঠিন। কাজেই আপনার মস্তিষ্ক মেয়েটিকে হিন্দু বানিয়ে দিয়েছে। তবে নামের কিছু মিল রেখেছে। সুলতানা হয়েছে সীতা।