আমার ক্ষেত্রেও নিশ্চয়ই এ রকম কিছু ঘটেছে। ক্ষুধা এবং ক্লান্তিতে শরীর অসন্ন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রবল হতাশা বোধ। আমার মস্তিষ্ক প্রবলভাবে উত্তেজিত হয়ে মৃত পুত্রকে উপস্থিত করেছে আমার সামনে।
নলিনী বাবুর লেখা কিছু কাগজ
আমার হাতে নলিনী বাবুর লেখা কিছু কাগজ। তিনি যে শুধু গাছপালা এবং আকাশের তারা দেখে বেড়াচ্ছেন তা না। মাঝে মাঝে লেখালেখিও করেছেন। যারা সুন্দর করে গল্প করে তারা সুন্দর করে লেখে। ব্যাপারটা নিপাতনে সিদ্ধের মতো।
নলিনী বাবু বেশ গুছিয়ে লিখেছেন। লেখাকে নানান অংশে বিভক্তও করেছেন। শুরুর অংশের নাম–ধন্যবাদ পত্র। এ রকম অনেক অংশ আছে। তবে সব লেখাই সংক্ষিপ্ত।
ধন্যবাদ পত্র
লেখক সাহেব! আপনি আমাকে অপূর্ব এক বাগানে ছেড়ে দিয়েছেন। আমি একা একা বাগানে হাঁটি। নিজেকে তখন আদি পুরুষ আদমের মতো মনে হয়। যেন এই পৃথিবীতে আমি একা। আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি স্বর্গের উদ্যানে। আমাকে স্বর্গবাসের সুযোগ করে দিয়েছেন, আপনাকে ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ পত্রের পরের অংশের নাম–সীতা।
সীতা
লেখক সাহেব! আপনি হঠাৎ করে সীতা প্রসঙ্গ তুলায় আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। ডায়েরি পড়ে বিস্ময়ের সমাপ্তি হয়েছে। বুঝতে পেরেছি ডায়েরিতে সীতার নাম পড়েছেন বলে তার বিষয়ে প্রশ্ন করেছেন। এক বিস্ময়ের সমাপ্তি হলেও এখন অন্য বিস্ময়! ডায়েরিতে এই নাম কে লিখল?
ডায়েরি
আমি অতি মনোযোগে ডায়েরি পড়েছি। জটিল সব জ্ঞানের কথা আমার মাথার উপর দিয়ে গিয়েছে। ডায়েরিতে একটি সংস্কৃত শ্লোক পড়ে অত্যন্ত অনিন্দিত হয়েছি। এই শ্লোক আমার মা বলতেন। আমি যেসব শ্লোক জানি সবই মার কাছ থেকে শেখা। এই শ্লেকিটা ভুলে গিয়েছিলাম।
ভেকো মমকায়তে
দিব্যং চূতফলং প্রাপ্য
ন গর্বং যাতি কোকিলঃ
পীত্বা কৰ্মপানীয়ং
ভেকো মকমকায়তে ॥
(অর্থ)
কোকিল আম ফল খেয়েও গর্বিত হয় না। কিন্তু ব্যাঙ কর্দমযুক্ত জলপান করেও গর্বে মকমক শব্দ করতে থাকে।
অশোক বৃক্ষ এবং অর্শ ব্যাধি
আজ একটি অশোক গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কি সতেজ প্রাণশক্তিতে ভরপুর এক বৃক্ষ। আমাদের বাড়ির পেছনে পুকুর ঘাটের কাছে একটা অশোক গাছ ছিল। কোনো এক বিচিত্র কারণে আমার মা গাছটাকে অত্যন্ত পছন্দ করতেন (আমার দুঃখ জগতের মার কথা বলছি। বাবার এক সময় অর্শ রোগ হলো। তিনি রোজ অশোক গাছের ছাল কেটে নিয়ে যেতেন। অর্শ রোগ থেকে মুক্তির জন্য সেই ছালসেদ্ধ রস খেতেন। মাকে দেখতাম গাছের ছাল কাটা অংশে হাত বুলাতে বুলাতে বলতেন, আহারে! আহারে। ছাল কাটার কারণেই হয়তো অশোক গাছ মারা যায় তবে বাবা সুস্থ হয়ে ওঠেন।
একটি রসিকতা
নীলগঞ্জ হাইস্কুলে পাঠদানের সময় আমি মাঝে কিছু রসিকতা করতাম। ছাত্রীরা প্রভূত আনন্দ পেত। তখনকার একটি রসিকতা হঠাৎ মনে পড়ায় একা একা অনেকক্ষণ হেসেছি। নুহাশ পল্লীর ম্যানেজার আমাকে বলল, কি হয়েছে? আমি বললাম, কিছু হয় নাই। ম্যানেজার চিন্তিত মুখে তাকাচ্ছে। মনে হলো সে ভেবেছে আমি আবারও পাগল হয়ে যাচ্ছি। রসিকতাটা বলি–এক তরুণী মেয়ের উপর বজ্রপাত হয়েছে। মেয়েটি মারা গেছে। কিন্তু তার মুখ ভর্তি হাসি। পাড়ার লোক অবাক হয়ে বলল, মেয়েটা বজ্রপাতের সময় হাসছিল কেন? মেয়ের মা বললেন, সে ভাবছিল ফ্ল্যাশ লাইট দিয়ে কেউ তার ছবি তুলছে, তাই হাসি হাসি মুখ করে ছিল।
ফিরে যেতে চাই
আমি ফিরে যেতে চাই। নীলগঞ্জে না। ক্লিনিকে ফিরে যেতে চাই।
ফিরে যেতে চাই অংশ পড়ে বিস্মিত হলাম। যিনি এই জায়গাটাকে স্বর্গভূমি বলছেন তিনি কেন স্বেচ্ছায় ত্রকে ফিরে যেতে চাইবেন? নুহাশ পল্লীর ম্যানেজারের সঙ্গে কথা হলো। সে বলল, স্যার উনার মাথা পুরাপুরি সারে নাই।
আমি বললাম, এ রকম মনে হচ্ছে কেন?
স্যার উনি নিজের মনে হাসেন। একবার দেখি টেলিস্কোপে তারা দেখতে দেখতে এমন হাসি শুরু করলেন। আমি দৌড় দিয়ে গেলাম। বললাম, কি হয়েছে? হাসেন কেন? উনি বললেন, স্বাতী নক্ষত্র দেখে হাসি এসে গেল। হাসি ছাড়াও উনার আরো পাগলামি আছে।
কি রকম?
কোনো একটা গাছ পছন্দ হলে উনি গাছের চারদিকে ঘুরতে থাকেন। আমি একবার দূর থেকে গুনেছি কত বার ঘুরেন। নাগলিঙ্গম গাছটার চারদিকে তিনি চল্লিশ বার ঘুরেছেন।
আমি বললাম, উনি খেয়ালি মানুষ বলে এই রকম করেন। তাঁর মধ্যে এই মুহূর্তে কোনো পাগলামি নেই। আমার অন্তত চোখে পড়ছে না।
ম্যানেজার বলল, আমি নিজে ভয়ে ভয়ে থাকি। এ রকম মানুষ তো দেখি নাই। কখন কোন বিপদ হয়।
কোনো বিপদ হবে না। তারপরও সাবধান থাকা ভালো।
স্যার আমি আপনার অনুমতি ছাড়া একটা কাজ করেছি। উনার যে কেয়ারটেকার আছে তাকে চিঠি লিখেছি চলে আসার জন্যে। পরিচিত একজন থাকলে উনার জন্যে ভালো। আমাদের জন্যেও ভালো। স্যার ঠিক আছে না?
হ্যাঁ ঠিক আছে।
সন্ধ্যা সবে মিলিয়েছে।
আমি আর নলিনী বাবু জাপানি ঘাটে বসে আছি। নলিনী বাবুর সঙ্গে টেলিস্কোপ আছে। খাতা-কলমও দেখছি। আমি বললাম, অন্ধকারে লিখবেন কি ভাবে?
নলিনী বাবু বললেন, আমার চোখের দৃষ্টি ভালো। আমি নক্ষত্রের আলোতেও লিখতে পারি। বেশিরভাগ লেখাই আমি তারা দেখার ফাঁকে ফাকে অন্ধকারে লিখেছি।
আপনার লেখায় পড়লাম আপনি ক্লিনিকে ফিরে যেতে চান। কেন?
নলিনী বাবু বললেন, ক্লিনিকে ফিরে যাবার পিছনে আমার কঠিন যুক্তি আছে। আপনি যুক্তিবাদী মানুষ। যুক্তি শুনলে নিজেই ক্লিনিকে ভর্তি করিয়ে দিয়ে আসবেন।