এইটুকু পড়ে কি করে বুঝলাম বানানো? কারণ ঐ তারিখে ইয়াহিয়া খান বেতারে কোনো ভাষণ দেননি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটা উপন্যাস লেখার কারণ আমি প্রতিদিনকার ঘটনা আলাদা করেছি।
এন ভট্যাচারিয়ার ডায়েরিতে ফিরে যাই। এন যে নলিনী বাবু তা বোঝা যাচ্ছে। ডায়েরির লেখাগুলি অত্যন্ত গোছানো। বেশিরভাগ ইংরেজি ভাষায় লেখা। আমি ভাষান্তর করেছি। প্রতিটি লেখার আলাদা শিরোনাম আছে। যেমন–
মুদ্রিত স্মৃতি
(Imprint memory)
কিছু স্মৃতি মস্তিষ্কে জন্মের পর পর তৈরি হয়। আগে থাকে না। হাঁসের বাচ্চার মুদ্রিত স্মৃতি হচ্ছে–চলমান বস্তুটি তোমার মা। জন্মের পর পর হাঁসের বাচ্চা চলমান কিছু দেখলেই তাকে মা মনে করে। তার পেছনে পেছনে চলতে থাকে।
অস্ট্রিয়ান জীববিজ্ঞানী কোনরাড লরেঞ্জ এই নিয়ে চমৎকার একটি পরীক্ষা করেন। ডিম থেকে বাচ্চা বের হবার পর পর তিনি চলমান বস্তু হিসেবে নিজেই আবির্ভূত হলেন। তিনি যেখানে যান, হাঁসের বাচ্চারা তাঁর পেছনে পেছনে যায়। তিনি পানিতে নামলে হাঁসের বাচ্চারাও তাঁর সঙ্গে পানিতে নামে। লরেঞ্জ তখন হাঁসের বাচ্চাদের মাকে উপস্থিত করলেন। বাচ্চারা ফিরেও তাকাল না। তারা লরেঞ্জের পেছনে পেছনেই ঘুরতে থাকল।
টিকা
প্রকৃতি হাঁসের বাচ্চাদের চলমান বস্তুকেই মা ভাবতে শিখিয়েছে কারণ হাঁস নিজে তা দিয়ে ডিম ফুটায় না। মুরগিকে এই কাজটা করতে হয়।
ডায়েরি পড়ে আমি নিজে খানিকটা চমকালাম কারণ আমি নিজেও জানতাম না যে হাঁস ডিমে তা দেয় না। হাঁসও যে কোকিলের মতো তা জানা ছিল না। নাগরিক লেখকরা গ্রামবাংলার অনেক সাধারণ তথ্যই জানেন না।
ডায়েরির লেখক ষয়েই লিখে গেছেন। আরেকটা উদাহরণ দেই।
সহজাত স্মৃতি
পাখিকে বাসা তৈরি করতে শেখাতে হয় না। মাকড়সাকে জাল বুনতে শেখাতে হয় না। এইমাত্র ডিম ফুটে বের হয়েছে মুরগির ছানারা তাদের গায়ে বা আশেপাশে উড়ন্ত শিকারি চিলের ছায়া দেখলে ভয়ে চেঁচাতে থাকে। অথচ তাদেরকে কেউ শিখিয়ে দেয়নি শিকারি চিলের ছায়া কেমন।
টীকা-১
অতি উন্নত মস্তিষ্ক হলো মানব মস্তিষ্ক। এই মস্তিষ্কের কি সহজাত বা মুদ্রিত স্মৃতি আছে? আমার ধারণা–নেই। মানুষের সব স্মৃতিই অর্জিত স্মৃতি। নিম্নশ্রেণীর প্রাণের জন্য প্রকৃতি সহজাত এবং মুদ্রিত স্মৃতির প্রয়োজন বোধ করেছে। উচ্চশ্রেণীর প্রাণের জন্য নয়।
টীকা-২
Johanes Schmidt
এই বিজ্ঞানী ইল মাছের সহজাত স্মৃতি প্রথম আবিষ্কার করেন। ইল মাছ, মিঠাপানির মাছ। নদীতে থাকে। ডিম পাড়ার সময় গভীর সমুদ্রে চলে যায়। বারমুদা দ্বীপের কাছে শৈবাল সাগরে (Sargasso Sea) সেখানেই ডিম পড়ে। ডিম পাড়ার পর পরই তারা মারা যায়। ডিম ফুটে যখন বাচ্চা বের হয় তখন তারা সমুদ্রে ভেসে উঠে এগিয়ে যেতে থাকে উত্তর দিকে। কিছু দূর যাবার পর ওরা দুদলে ভাগ হয়ে যায়। একদল যেতে থাকে উত্তর আমেরিকা থেকে কারণ তাদের মায়েরা এসেছিল উত্তর আমেরিকা থেকে। আরেক দল যেতে থাকে ইউরোপের দিকে। কারণ তাদের মায়েরা এসেছিল ইউরোপ থেকে। তারা নদী-নালায় বড় হতে থাকে। ডিম পাড়ার সময় হলে আবারও হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে শৈবাল সাগরের দিকে যাত্রা।
ডায়েরি লেখকের মূল লেখক স্মৃতি বিষয়ে। RNA স্মৃতির কেরিয়ার কি-না সে বিষয়ে নানান কথা। এবং বেশ জটিল কথা।
কয়েক জায়গায় দেখলাম ভবিষ্যদ্বক্তা নস্ট্রাডেমাসের নাম। ইনি পাঁচশ বছর আগে ফ্রান্সে জন্মেছিলেন। হাজার বছরের পৃথিবীর ভবিষ্যৎ লিখে গেছেন। তাঁর সব ভবিষ্যদ্বাণী ছিল চারপদের কবিতায়। এদের বলা হয় কোয়াট্রেন। কোয়াট্রেনের ভাষী বেশ জটিল এবং রূপকাশ্রয়ী।
নস্ট্রাডেমাসের বেশিরভাগ ভবিষ্যদ্বাণী ফলে গিয়েছে। যেমন তিনি আমেরিকা নামক দেশ আবিষ্কার হবে বলেছেন। এটম বোমার ধ্বংসযজ্ঞের কথা বলেছেন। ফরাসি বিপ্লবের কথা বলেছেন।
ডায়েরিতে নস্ট্রাডেমাসের একটি কোয়াট্রেন দেয়া আছে। তার পাশে বাংলায় লেখা এর অর্থ কি আমি যা ভাবছি তা?
কোয়াট্রেনটা এই–
মানুষ একজন অসংখ্য সে
যেমন এক বৃক্ষ অসংখ্য পত্র
কিছু আলো, কিছু অন্ধকার
প্রাসাদ একটি তার অসংখ্য দোয়ার
আমি ডায়েরির খানিকটা পড়ে নিশ্চিত হলাম এর লেখক আমাদের নলিনী বাবু B.Sc. হতেই পারেন না। এত ব্যাপক পড়াশোনা তার থাকার কোনো কারণ নেই। যিনি সব লেখকের একটি মাত্র বই পড়েন তাঁর পাঠাভ্যাস নেই। গ্রামের একজন স্কুল শিক্ষকের হাতের কাছে বইপত্রও থাকে না।
ডায়েরি নলিনী বাবুর লেখা না অন্য কোনো মানুষের লেখা এই তথ্য যে অতি সহজেই প্রমাণ করা যায় তা আমার মাথায় অনেক দিন আসেনি। আমাদের মস্তিষ্ক রহস্য সমাধানে সহজ পথে যেতে চায় না। মস্তিষ্ক নিজে জটিল বলে খুঁজে জটিল পথ।
আমার কাছে নলিনী বাবুর হাতে লেখা সংস্কৃত শ্লোকের খাতা আছে। খাতার লেখা এবং ডায়েরির বাংলা লেখা মিলিয়ে দেখলেই রহস্যের সমাধান হয়। খাতার লেখা এবং ডায়েরির লেখা মিলিয়ে দেখলাম। হস্তাক্ষর বিশেষজ্ঞ না হয়েও যে কেউ বলবে একই হাতের লেখা। স্কুল শিক্ষক নলিনী বাবুই জটিল সব তথ্য লিখেছেন এবং ডায়েরিতে সংস্কৃতি শ্লোকও আছে। একটাই শ্লোক। জটিল প্রসঙ্গের শেষে শ্লোকটা লেখা–
ন হি সর্ববিদঃ সর্বে
আমি সংস্কৃত জানি না বলে এর অর্থ উদ্ধার করতে পারলাম না। মিসির আলি সাহেব নামে বাস্তবে কেউ থাকলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃত জানে এমন কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। আমি একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। অভিনেতা এবং আবৃত্তিকার। অনেক সংস্কৃত শ্লোক উনার মুখস্থ। তিনি হয়তো এই শ্লোকের অর্থ জানবেন। জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় বললেন, জীবনে প্রথম শুনলাম। অর্থ কি জানি না।