আমরা কেউ কোনো কথা বলছি না। কারণ, ক্যাসেট প্লেয়ার চালু আছে। ভূতের কণ্ঠস্বর রেকর্ড করা হবে।
সালেহ চৌধুরীর সমস্যা হচ্ছে (আমি তাকে নানাজি ডাকি), তিনি বেশিক্ষণ কথা না বলে থাকতে পারেন না। কোনো না কোনো প্রসঙ্গে তার কথা বলতেই হবে। পাঁচ মিনিট পার হওয়ার আগেই তিনি বললেন, টিউবওয়েল আসার পর কুয়া উঠে গেছে। কুয়াতলা সুন্দর একটা জায়গা। টিউবওয়েলতলা বলে কিছু নেই।
আমি বললাম, নানাজি চুপ করে থাকুন। ভৌতিক কণ্ঠস্বর রেকর্ড হবে।
তিনি মিনিট দুই চুপ করে থেকে বললেন, কুয়াতে বালতি পড়ে গেলে আঁকশি নামের এক বস্তু দিয়ে তোলা হতো। তুমি আঁকশি দেখেছ?
আমি বললাম, আঁকশি দেখেছি। আপনি চুপচাপ বসে সিগারেট খান।
তিনি সিগারেট ধরালেন। সিগারেট শেষ হওয়া পর্যন্ত চুপ করে থেকে নিজেই এক জ্বিন নামানোর গল্প শুরু করলেন। এই গল্প থেকে তাকে আর আটকানো গেল না। নানান শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে গল্প চলতেই থাকল। জিন থেকে কিভাবে কিভাবে মুক্তিযুদ্ধের গল্পে চলে এলেন। যুদ্ধ করতে গিয়ে কি বিপদে পড়েছেন, মিলিটারির তাড়া খেয়ে কিভাবে ঝাঁপ দিয়ে নদীতে পড়েছেন। এইসব গল্প শুরু হয়ে গেল। আমি জানি এখন আর তাঁকে থামানো যাবে না। হতাশ হয়ে ক্যাসেট প্লেয়ার বন্ধ করে দিলাম।
নীলগঞ্জ থেকে খালি হাতেই ফেরার কথা ছিল। খালি হাতে ফিরলাম। হলুদ প্লাস্টিকের মলাট দেয়া একটা ডায়েরি নিয়ে ফিরলাম। ডায়েরি পাবার গল্প করা যেতে পারে।
রাতে আমাদের দুজনের থাকার জায়গা হলো দোতলা ঘরে। প্রাচীন আমলের বড় কালো রঙের খাটে দুজনের শোবার ব্যবস্থা। রামচন্দ্র সব গুছিয়ে রেখেছে। ধোয়া চাদর, পরিষ্কার বালিশ, কোল বালিশ। নানাজি বললেন, ভালো ব্যবস্থা। আরাম করে ঘুম দেয়া যাবে। কিন্তু তিনি ঘুমের দিকে মোটেই গেলেন না। আয়োজন করে মুক্তিযুদ্ধের এক অপারেশনের গল্প শুরু করলেন। এই গল্প আগেও কয়েকবার শুনেছি। একবার যখন শুরু হয়েছে আবারও শুনতে হবে। উদ্ধার পাবার পথ দেখছি না। নানাজি যখন গল্পের এক ফাকে রামচন্দ্রকে বললেন, ফ্লাস্কে করে চা দেয়া যাবে? তখন আমি পুরোপুরি হতাশ হয়ে গেলাম। পরিষ্কার বুঝতে পারছি নানাজি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় যাচ্ছেন।
আমাকে উদ্ধার করল রামচন্দ্র। সে ফ্লাস্ক ভর্তি চা নিয়ে এসে বলল, আমি যে ঘরে আগে ঘুমাইতাম সেইখানে একটা পেততুনি থাকে। এই কারণে দোতলায় আর থাকি না।
আমি নামাজিকে বললাম, পেততুনি যে ঘরে থাকে সেই ঘরটা একটু দেখে আসি। তারপর আপনার গল্পের বাকিটা শুনব।
নানাজি বললেন, পেততুনির ঘর দেখার কি আছে?
আমি বললাম, যাব আর আসব। আপনি সিগারেট ধরান। আপনার সিগারেট শেষ হবার আগেই আমি উদয় হব।
পেততুনির ঘর দোতলার শেষ মাথায়। গুদাম ঘর টাইপ। দুনিয়ার জিনিসপত্রে ঠাসা। কোনোমতে একটা চৌকি বসানো। চৌকির উপর পাটি বিছানো। পাটির উপর ঢাকনা দেয়া মটকি। সেখান থেকে মিষ্টি গন্ধ আসছে। বেশ বড়সড় আলমারি আছে। যার বেশিরভাগ কাচই ভাঙা। ভাঙা কাচের ভেতর দিয়ে কিছু বইপত্র দেখা যাচ্ছে। পঞ্জিকা, রামায়ণ, গীতাভাষ্য ধরনের বই। একটি বাড়িতে কি ধরনের বই পাঠ করা হয় তা থেকে বাড়ির বাসিন্দাদের মানসিকতা আঁচ করা যায়। আমি হারিকেন হাতে বইয়ের সংগ্রহের দিকে এগিয়ে গেলাম। রামচন্দ্র ধারা বর্ণনার মতো পেততুনি বিষয়ে বলে যেতে লাগল।
স্যার পেততুনি কি জানেন?
না।
অল্পবয়েসি মেয়ে ভূত। মেয়ে ছেলের যত বদমাইশি থাকে এরারও তাই থাকে। এই যে মুটকি দেখতেছেন, এর ভিতরে আছে রসা। রসা বুঝেন স্যার? খেজুর গুড়ের রস। পেততুনিটা রেজি রাইতে আইসা রসা খায়। খায় আর খিকখিক কইরা হাসে।
রামচন্দ্র বকরবকর করে যাচ্ছে আর আমি বই ঘাটছি। তখনই হলুদ মলাটের একটা ডায়েরি পাওয়া গেল। পুরোটাই ইংরেজিতে লেখা। মাঝে মাঝে বাংলায় নোট। ডায়েরির প্রথম পাতায় বড় বড় করে লেখা–Dream Analogy. লেখক N. Vattachary,
এই N. Vattacharyaই কি আমাদের নলিনী বাবু? আমি রামচন্দ্র এই ডায়েরিটা কি নলিনী বাবুর?
জানি না স্যার। তারপর শুনেন ঘটনা, এক রাইতের ঘটনা শুনেন। আমি শুইয়া আছি, হঠাৎ বুঝলাম কেউ একজন আমার পায়ে হাত দিছে। ঠাণ্ডা হত। চিকন আঙ্গুল। আমি তো চমকায় উঠলাম। বুঝছি পেততুনির খেলা। এখন করব কি ভাইবা পাইতাছি না। ঝাপটায়া ধরব? ঝাপটায়া ধরলে পেতৃতুনি কি করে তাও জানি না। স্যার আমার বিপদ বুঝতেছেন?
আমি রামচন্দ্রের বিপদ বুঝতে না পারলেও নিজের বিপদ পরিষ্কার বুঝতে পারছি। নানাজির সঙ্গে থাকলে সারারাত মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন অপারেশনের গল্প শুনতে হবে। আর রামচন্দ্রের সঙ্গে থাকলে শুনতে হবে পেতনির গল্প। আমাকে ঠিক করতে হবে আমি কি শুনতে চাই।
ব্যক্তিগত ডায়েরির প্রতি আকর্ষণ
ব্যক্তিগত ডায়েরির প্রতি আমার আকর্ষণ আছে। তবে সেই সব ডায়েরি যা একদিন প্রকাশিত হবে ভেবে লেখা হয়নি। যেমন আনা ফ্রাংকের ডায়েরি।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কথা নিয়ে অনেক লেখকের ব্যক্তিগত ডায়েরি প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিটি আমি মন দিয়ে পড়েছি। অনেক বার ধাক্কার মতো খেয়েছি। ডায়েরি পড়তে গিয়েই বুঝেছি বিষয়টা বানানো। একটা উদাহরণ দিয়ে পরিষ্কার করছি।
আজ … তারিখ বৃহস্পতিবার। বাসায় গরুর মাংস রান্না হয়েছে। আমার মন বিক্ষিপ্ত বলে না খেয়ে শুয়ে আছি। রেডিও পাকিস্তানে ইয়াহিয়ার ভাষণ শুনে মন আরো খারাপ হলো। মন ঠিক করার জন্য ডায়েরি লিখতে বসেছি। কি লিখলে মন ভালো হবে তাও বুঝতে পারছি না।