হেকিম নামে আমি কাউকে চিনি না। আপনি ছোট বাজারে খোঁজ নেন।
ছোট বাজার বড় বাজার সব বাজারেই গেলাম। হেকিম নামে কোনো কাঠমিস্ত্রির সন্ধান পাওয়া গেল না। সন্ধান পেলে তার কাছ থেকে কিছু জানা যেত।
সুলতানা বেগম নামে দশম শ্রেণী খ শাখা বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রীটির খোঁজ করার চেষ্টা করলাম সে নীলগঞ্জে নেই। তার বিয়ে হয়ে গেছে। সে স্বামীর সঙ্গে আছে। স্বামী খুলনার মংলা পোর্টে আছে।
সুলতানার ছোট বোনের নাম আফসানা। আমি তার কাছেও গেলাম। আমাকে দেখে কোনো কারণ ছাড়াই ভয়ে অস্থির হয়ে গেল। আমি বললাম, আফসানা তুমি কি আমাকে চেনো?
আফসানা বলল, আমি আপনাকে চিনি না। আমি গল্পের বই পড়ি না।
আমি বললাম, তুমি যে আমাকে চেনো না বললে এটা ঠিক না। তুমি বলেছ তুমি গল্পের বই পড়ে না। যে আমাকে চেনে না তার জানার কথা না যে আমি গল্প লিখি। এখন বলো তুমি কি নলিনী বাবুকে চেনো? নাকি তাকেও চিনো না?
আফসানা মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি বললাম, নলিনী বাবু কি তোমাদের বাড়িতে কখনো এসেছেন। তোমার বড় আপার কাছ থেকে গল্পের বই নিতে বা বই ফিরত দিতে।
আফসানী বলল, কোনোদিন আসেন নাই। কেউ যদি এই কথা বলে সে শত্রুতা করে বলেছে।
আফসানার সঙ্গে আর কথা বলা বৃথা আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালাম।
নলিনী বাবু বিষয়ে আমি কোনো নতুন তথ্যই পেলাম না। তার বাড়ি দেখতে গেলাম। বাড়ি একজন কেয়ারটেকার দেখাশোনা করে, তার নাম রামচন্দ্র। সে খুব আগ্রহ নিয়ে তালা খুলে বাড়িঘর দেখাল। তার অতিরিক্ত আগ্রহের কারণ আমার কাছে স্পষ্ট হলো না। একটু পরপর বলছে, রাতে একটু সেবা নিবেন। সেবা নেওয়ার অর্থ যে রাতে ডিনার করতে হবে তা বুঝতেও অনেক সময় লাগল।
নলিনী বাবুর বাড়িতে রাতে সেবা নিলাম। সেবা না নিলেই ভালো হতো। তার প্রতিটি খাবারই অখাদ্য। মুরগি রান্না করেছে। লবণ যতটুকু প্রয়োজন তার তিনগুণ দিয়েছে। অতিরিক্ত লবণ সে পুষিয়ে দিয়েছে ডাল এবং সবজিতে। সেখানে একেবারেই লবণ নেই।
রাতেই ঢাকায় ফিরে যেতে চাচ্ছিলাম, মাইক্রোবাসের ড্রাইভার বলল, গাড়ির চাকা পাংচার হয়েছে। স্পেয়ার চাকায় হাওয়া নাই। নেত্রকোনা থেকে চাকা ঠিক করিয়ে আনতে হবে।
বাধ্য হয়ে নলিনী বাবুর বাড়িতেই রাত্রি যাপনের সিদ্ধান্ত নিলাম। রামচন্দ্রকে খুবই আহ্লাদিত মনে হলো।
রামচন্দ্র পান নিয়ে এসেছে। আমি পান চিবাচ্ছি, সিগারেট টানছি। রাতের কুৎসিত খাবারের দুঃখ ভুলার চেষ্টা করছি তখন রামচন্দ্র ভয়ঙ্কর এক গল্প ফাঁদল। আমার শরীর কেঁপে উঠল। একবার নলিনী বাবুর বাবা তার শিশুপুত্রকে শায়েস্তা করার জন্য কুয়ার ভেতর ফেলে দিয়েছিলেন। অনেক ঝামেলা করে তাকে কুয়া থেকে উদ্ধার করা হয়।
আমি বললাম, তখন নলিনী বাবুর বয়স কত?
চার-পাঁচ বছর।
এরপরই তার মধ্যে মৃগী রোগের লক্ষণ দেখা যায়।
তুমি কতদিন এই বাড়িতে আছ?
দিনের হিসাব তো করি নাই। মেলা দিন ধইরা আছি। ত্রিশ-চল্লিশ বছর হইতে পারে। আমার স্ত্রী-পরিবার সব ইন্ডিয়াতে চলে গেছে। আমি পইরে আছি।
কেন?
বাড়িটার উপরে মায়া চইলা আসছে এইজন্যে। মায়া কঠিন জিনিস। এই বাড়ির কুয়াতে ভূত আছে। ভুতের জন্যে মায়া।
সালেহ চৌধুরী বললেন, ভূতের জন্য মায়া মানে কী?
রামচন্দ্র জানালা দীর্ঘদিন কোনো পশু-পাখির সঙ্গে বাস করলে তার জন্যে মায়া জন্মে। একইভাবে দীর্ঘদিন কোনো ভূতের সঙ্গে বাস করলে ভূতের প্রতি মায়া জন্মে।
আমি বললাম, ভূতটা কুয়ায় বাস করে?
রামচন্দ্র বলল, হুঁ। স্যারের স্ত্রী কুয়াতে ঝাঁপ দিয়া পইড়া মারা গেছিলেন। তারপর থাইকা ভূত হইয়া কুয়ায় বাস করেন।
আমি বললাম, নলিনী বা আমাকে বলেছিলেন, তার মা ফাঁস নিয়ে মারা যান।
রামচন্দ্র বলল, ছোট স্যার পেরায়ই উল্টাপাল্টা কথা বলেন। আমারে পেরায়ই ডাকেন বড় মামা। আমি তো উনার মামা না। আপনারা কি ভূতের আলামত কিছু দেখতে চান?
কী আলামত দেখাবে?
কুয়াতলায় বইসা থাকবেন, রাইত গভীর হইলে শুনবেন, কুয়ার ভিতরে কেউ সাঁতার কাটতাছে। ভাগ্য ভালো থাকলে তার কথা শুনবেন।
তুমি শুনেছ?
অনেকবার শুনেছি। ছোট স্যার যখন চিকিৎসার জন্যে ঢাকা যায়, তখন কুয়ার পাড়ে আমি যতবার বসছি, ততবারই উনার কথা শুনেছি।
কী কথা?
উনি বলেন, ও চন্দ্র! আমার ছেলে কই? তাকে একলা কেন ছাড়লি। তুই কেন সাথে গেলি না?
তোমাকে চন্দ্র ডাকে? রামচন্দ্র ডাকে না? ভূত মুখে রামনাম নিতে পারে না। এই জন্য চন্দ্র ডাকে।
এক সমস্যা জানতে এসে আমরা ভূত সমস্যায় জড়িয়ে পড়লাম। কুয়ার পাড়ে বসে ভূতের কথা শোনার অভিজ্ঞতা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করার অর্থ হয় না। সঙ্গে ক্যাসেট রেকর্ডার আছে। রেকর্ডার চালু থাকবে। ভূত কোনো কথা বললে রেকর্ড হয়ে যাবে। বন্ধু-বান্ধবদের ভূত্রে গল্প শোনানোর সময় ভূতের কণ্ঠস্বর শুনিয়ে দেব।
কুয়াতলাটা সুন্দর। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। একটু দূরে প্রকাণ্ড কাঁঠাল গাছ। গাছের ডালপালা কুয়ার ওপর পর্যন্ত চলে এসেছে। আমি এবং সালেহ চৌধুরী কুয়ায় হেলান দিয়ে বসেছি। পঞ্চমীর চাঁদের আলো কাঁঠাল গাছের পাতা ভেদ করে আমাদের গায়ে পড়ে অদ্ভুত সব নকশা তৈরি করছে। দূরে কোথাও কামিনী ফুলের ঝাক আছে। বাতাসে মাঝে মাঝে ফুলের সৌরভ ভেসে আসছে। সারাক্ষণ এই গন্ধ নাকে লাগলে ভালো লাগত না। মাঝে মাঝে গন্ধ পাচ্ছি বলে ভালো লাগছে।