স্বপ্নের একটা ব্যাখ্যা আমি দাঁড়া করলাম। নর্থ ডাকোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন Ph.D করি তখন আমার সহপাঠী রালফ নামের এক আমেরিকান ছাত্রের সঙ্গে পালতোলা নৌকা ভ্রমণে গিয়েছিলাম। তার সঙ্গে ছিল তার স্ত্রী এবং বাচ্চা একটা মেয়ে। আমেরিকান পালতোলা নৌকা বাতাস পেলে তীব্র গতিতে ছুটে। ঘন নীল পানিতে আমরা ছুটছিলাম তীব্র গতিতে। আমাদের সবার গায়ে লাইফ জ্যাকেট ছিল। রালফ নৌকার পাল ধরেছিল, সে ছিল খালি গায়। তার পরনে ছিল লাল প্যান্ট।
আমার স্বপ্নে দেখা জলযান রালফের পালতোলা নৌকা। এবং বাচ্চা মেয়েটি হচ্ছে রালফের মেয়ে। বাচ্চা মেয়েটিকে দেখে আমার হয়তো মনে হয়েছিল, ইশ এ রকম একটা রূপবতী কন্যা যদি আমার থাকত! প্রকৃতি দীর্ঘদিন পর স্বপ্নের মাধ্যমে আমার ইচ্ছা পূরণ করেছে।
নলিনী বাবুর ব্যাপারটা শুধু পরিষ্কার হচ্ছে না। হয়তো অবচেতন মনে তিনি আছেন বলেই স্বপ্নে ধরা দিয়েছেন।
আমি বিজ্ঞানের বই সময় পেলেই পড়ি। কোয়ান্টাম মেকানিক্স আমার প্রিয় বিষয়। Entenglement নিশ্চয়ই সেখান থেকেই আছে।
স্বপ্নের ব্যাপারটা পুরোপুরি যুক্তির ভিতর নিয়ে আসার পরেও নলিনী বাবু গলায় মাছের কাঁটার মতোই অস্বস্তি নিয়ে বিঁধে রইল। আমি এক সন্ধ্যাবেলা ঠিক করলাম নলিনী বাবুর খোজে বের হব। নীলগঞ্জ যাব।
মিসির আলী নামে আমার একটা চরিত্র আছে। এই মিসির আলি সব সমস্যা যুক্তি দিয়ে সমাধান করার চেষ্টা করেন। সমস্যা সমাধানের জন্যে হেন জায়গা নেই যেখানে সে যায় না। বাস্তবে মিসির আলির অস্তিত্ব থাকলে সে এই কাজটাই করত। অবশ্যই নীলগঞ্জে যেত। এক অর্থে আমিই তো মিসির আলি। আমি কেন যাব না? সমস্যা হচ্ছে আমি একা কোথাও যেতে পারিনি। যে কোনো যাত্রায় আমার সঙ্গী লাগে। সঙ্গী জোগাড় করতে পারছিলাম না। সবাই ব্যস্ত। আমার মতো অবসরে কেউ নেই। মাসখানেক পার হওয়ার পর সালেহ চৌধুরী (সহ-সম্পাদক, দৈনিক বাংলা) রাজি হলেন। আমরা মাইক্রোবাসে করে রওনা হলাম।
মাইক্রোবাস যাচ্ছে
মাইক্রোবাস যাচ্ছে, কিন্তু যাচ্ছেটা কোথায়? আমার কাছে কোনো ঠিকানা নেই। নলিনী বাবুর কাছ থেকে জানি তার স্কুলের নাম নীলগঞ্জ গার্লস হাই স্কুল। তাঁর বাবী শ্রীকান্ত ভট্টাচার্য ময়মনসিংহ থেকে নীলগঞ্জ আসতেন কাজেই জায়গাটা ময়মনসিংহ জেলায়।
আমি মিসির আলির মতো মাথা খাটালাম। ময়মনসিংহ জেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে জানতে চাইলাম নীলগঞ্জ গার্লস হাই স্কুল কোথায়? তিনি সঙ্গে সঙ্গে ঠিকানা দিলেন।
সালেহ চৌধুরী বললেন, তোমার ভালো বুদ্ধি। এইভাবে ঠিকানা বের করার কথা আমার মাথায় আসে নাই।
আমি বললাম, আমার বুদ্ধি মিসির আলির চেয়েও বেশি।
সালেহ চৌধুরী বললেন, না হবে না। মিসির আলি সাহেবের এ্যানালাইটিক্যাল রিজনিং অসাধারণ।
আমি এই ভেবে আনন্দ পেলাম যে সালেহ চৌধুরী মিসির আলিকে উপন্যাসের চরিত্র হিসেবে দেখছেন না। অতি বুদ্ধিমান মানুষও মাঝে মাঝে বাস্তব-অবাস্তব সীমারেখা মনে রাখতে পারেন না।
নীলগঞ্জ গার্লস হাই স্কুলে উপস্থিত হলাম ঠিকই কিন্তু নলিনী বাবুকে পেলাম না। তিনি অসুস্থ। কোনো এক মানসিক রোগীদের ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন। ক্লিনিকটা কোথায় পরিষ্কার করে কেউ বলতে পারল না। হেডমাস্টার সাহেব বললেন, খুব সম্ভব চিটাগাংয়ে। নলিনী বাবুর এক আত্মীয় ডাক্তার। তিনি থাকেন চিটাগাংয়ে। নলিনী বাবু অসুস্থ হলে তিনিই চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
নীলগঞ্জ হাইস্কুলের ধর্মশিক্ষক বললেন, ক্লিনিকটা ঢাকায়। তিনি নাকি একবার কথায় কথায় জেনেছেন। হেডমাস্টার সাহেবের সঙ্গে কথাবার্তা যা হলো, তা এ রকম–
আমি : নলিনী বাবুর বাবা সম্পর্কে কি জানেন? শ্রীকান্ত ভট্টাচার্য।
হেডমাস্টার : উনি মারা গেছেন।
আমি : মানুষ কেমন ছিলেন?
হেডমাস্টার : মৃত ব্যক্তির দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলাপ শোভন না। উনার কিছু দোষ-ত্রুটি ছিল। তবে নলিনী বাবু সর্বদোষমুক্ত মানুষ।
আমি : নলিনী বাবু সম্পর্কে বলুন।
হেডমাস্টার : বললাম না, উনি সর্বদোষমুক্ত মানুষ।
আমি : উনার অসুখ বিষয়ে বলুন।
হেডমাস্টার : মৃগী রোগ ছিল। মাথা খারাপের কিছু লক্ষণও ছিল।
আমি : নলিনী বাবুর বিশেষ কোনো কিছু কি আপনার চোখে পড়েছে?
হেডমাস্টার : না।
আমি : মাথা খারাপের কি লক্ষণ ছিল?
হেড মাস্টার : স্মরণে আসতেছে না।
আমি : তিনি অদ্ভুত কিছু দেখেন এইসব কখনো বলতেন?
হেড মাস্টার : শিক্ষার বাইরে অন্য আলাপ আমার স্কুলে নিষিদ্ধ। কারণ শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। আমাদের নবিজি বলেছেন, শিক্ষার প্রয়োজনে সুদূর চীন দেশে যাও।
গ্রামের মানুষরা এমনিতে প্রচুর কথা বলে। বিপত্তি তখনই হয় যখন কথাবার্তার সময় একটা রেকর্ডিং ডিভাইস সামনে থাকে। হেডমাস্টার সাহেবের চোখ-মুখ শক্ত। তিনি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তার সামনে রাখা ক্যাসেট রেকর্ডারের দিকে। আমি ক্যাসেট রেকর্ডার সরিয়ে দিলাম, তাতেও লাভ হলো না।
আমি তাঁকে আশ্বস্ত করার জন্য তাঁর হাত ধরে কোমল গলায় বললাম, হেড মাস্টার সাহেব, আপনার কাছে নলিনী বাবুর কোনো অস্বাভাবিকতা ধরা পড়েনি?
জি না।
হেকিম নামে কোনো কাঠমিস্ত্রিকে চেনেন? নলিনী বাবু বলেছিলেন সে খুব ভালো কাঠমিস্ত্রি। নলিনী বাবু তাকে দিয়ে আমার জন্যে একটা ইজি চেয়ার বানিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।