মাঝিরা তাই করল। লবণদহের মাঝামাঝি বজরা নিয়ে খুঁটি গাড়ল। আমি বাতি নিভিয়ে দিলাম। এক সময় প্রবল বৃষ্টি শুরু হলো। সঙ্গে বাতাসও আছে। নৌকা দুলছে। আমার ভয় ভয় করতে লাগল। আমি বললাম, রাতে ডাকাত ধরবে না তো?
মাঝি বলল, স্যার ধরতেও পারে। এই হাওরে পেরায়ই ডাকাতি হয়।
প্রায়ই ডাকাতি হয় তাহলে এখানে বজরা এনেছ কেন?
আপনে বলছেন বইল্যা আনছি। নিজ ইচ্ছায় আনি নাই।
আমি বললাম, বজরা ফিরিয়ে নিয়ে চলো। নুহাশ পল্লীর কাছে নিয়ে খুঁটি পোঁত। ডাকাতের হাতে পড়া কোনো কাজের কথা না।
ইঞ্জিনের বজরা। ইঞ্জিনে বাতাস ঢুকেছে বলে স্টার্ট নিচ্ছে না। শেষটায় মাঝিরা লগি এবং বৈঠা নিয়ে যাত্রা শুরু করল। সাপে বরের মতো হলো। ইঞ্জিনের বিকট আওয়াজ থেকে মুক্তি। জল-বিলাসের ছাদে বৃষ্টি পড়ছে। অপূর্ব সঙ্গীতের মতো শুনাচ্ছে। আমি গায়ে চাদর দিয়ে বসে আছি। বৃষ্টি সঙ্গীত শুনছি। আমার সামনে কাগজ-কলম। বজরার ভেতর দুটা হারিকেন জ্বলছে। অন্য রকম পরিবেশ হয়তো আমার মধ্যেই ঘোরের মতো তৈরি করল। আমি একটা গান লিখে ফেললাম। এর অনেক দিন পর শাওন গানটি রেকর্ড করেছে। গানটি উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না।
যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো এক বরষায়
এসো ঝর ঝর বৃষ্টিতে
জল ভরা দৃষ্টিতে… (ইত্যাদি)
গান রচনা শেষ করে কখন বিছানায় শুয়েছি আর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি কিছুই মনে নেই। ঘুমের মধ্যে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নে সব কিছু বদলে যায়। বজরাটা বদলে গেল। আমি দেখলাম অতি আধুনিক একটা স্টিলবডির জলযানে আমি বসে আছি। জলযান তীব্র গতিতে ছুটছে। আমার পাশে ছয়-সাত বছরের একটি বালিক। আমাদের দুজনের গায়েই লাইফ জ্যাকেট বাঁধা। আমাদের সামনে বসে আছেন নলিনী বাবু। তার পরনেও লাইফ জ্যাকেট। নলিনী বাবুর হাতে একতাড়া কাগজ। আমাদের জলযান (বড় স্পিডবোটের মতো। স্পিডবোট চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এক বিদেশি। তার চোখে কালো চশমা। লাল হাফপ্যান্ট পরা। খালি গা।)
দৃশ্য রাতের না। দিনের। যতদূর চোখ যায় ঘন নীল জলরাশি। আমার পাশে বসা বাচ্চা মেয়েটির হাতে পেনসিল। সে পেনসিল দিয়ে ছবি আঁকছে। আমি মেয়েটিকে চিনতে পারছি না।
মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা! আমি মার কাছে যাব।
মেয়েটি আমাকে বাবা কেন ডাকছে বুঝতে পারছি না। অতি রূপবতী এই বালিকা আমার অপরিচিত। নলিনী বাবু বললেন, মা আমরা তোমার মার কাছেই যাচ্ছি।
মেয়েটি বলল, তুমি কথা বলবে না। আমি পেনসিল দিয়ে তোমাকে খোচা দেব।
নলিনী বাবু বললেন, আমাকে কেন খোচা দিবে? মেয়েটি বলল, পেনসিল দিয়ে খোঁচা দিতে আমার ভালো লাগে।
স্বপ্ন দৃশ্য ছাড়াছাড়া হয়। আমি যা দেখছি তা ছাড়াছাড়া কিছু না। মানুষ তার স্মৃতিতে সঞ্চিত জিনিসই স্বপ্নে দেখে এবং স্বপ্ন হয় সাদাকালো। আমি রঙিন স্বপ্ন দেখছি এবং আমার স্মৃতিতে বাচ্চা মেয়েটি অবশ্যই নেই। তাকে আমি আগে কখনো দেখিনি।
নলিনী বাবু বললেন, আমি আপনার জন্যে কিছু কাগজপত্র নিয়ে এসেছি। আমি অন্য ভুবন থেকে এসেছি। আমি আপনার পরিচিত নলিনী বাবু B.Sc না। আমি পার্টিক্যাল ফিজিক্সে Ph.D করেছি। কিছু কাগজপত্র আমি আপনাকে দেব। আপনি কাগজপত্রগুলি শার্টের ভেতর ঢুকিয়ে রাখবেন। যাতে এগুলি থেকে যায়। বুঝতে পারছেন?
আমি বললাম, না। কিছুই বুঝতে পারছি না। শুধু আমি একটা বিচিত্র স্বপ্ন দেখছি এটা বুঝতে পারছি।
নলিনী বাবু বললেন, আপনি স্বপ্ন দেখছেন না। আমি প্যারালাল ওয়ার্ল্ড থেকে এসেছি। দুটা জিনিস আপনাকে বুঝাব। একটা হলো Borrormeen ring. তিনটা রিং একত্র করা। এটা হলো টপলজিক্যাল একটা গিফ্ট। একটা রিং খুললেই তিনটা আলাদা হয়ে যাবে।
আরেকটা ইচ্ছে Hopf ring. এর একটা খুললে দুটা আটকে থাকবে। আলাদা হবে না। বুঝতে পারছেন? আমি এঁকে দেখাচ্ছি। খুকি তোমার পেনসিলটা দাও।
বাচ্চা মেয়েটা বলল, আমি পেনসিল দিব না। আমি পেনসিল দিয়ে খোঁচা দেব।
নলিনী বাবু বললেন, আপনি কাগজগুলি রাখুন। এখানে entanglement সম্পর্কে সুন্দর করে বলা আছে। সহজ কথায় entangleinent হচ্ছে দুটি Particle-এর মাঝখানের দূরত্ব এক মিলিয়ন বা এক বিলিয়ন মাইল হলেও এরা অতি রহস্যময়ভাবে একে-অন্যের সঙ্গে যুক্ত। একটির কোনো পরিবর্তন হলে সঙ্গে সঙ্গে অন্যটিরও পরিবর্তন হবে। আমি মূলত স্পিন পরিবর্তনের কথা বলছি। হাতে সময় নেই। কাগজগুলি রাখুন।
আমি কাগজ হাতে নিলাম।
শার্টের ভেতর কাগজগুলি ঢুকিয়ে চাদর মুড়ি দিন। এবার কুকুর কুণ্ডলী হয়ে শুয়ে থাকুন, যেন কাগজ চলে না যায়।
আমি তাই করলাম আর তখনই বিকট বজ্রপাতে ঘুম ভাঙল। জেগে উঠে দেখি আমি বজরায় আমার ঘরে শুয়ে আছি। বজরা নুহাশ পল্লী ঘাটে বাঁধা। মাঝি বলল, স্যার কি জাগনা?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
ঠাড়া কেমন পড়ছে দেখছেন। আরেকটু হইলে বজরায় ঠান্ডা পড়ত। পুইড়া কইলা হইতাম।
আমি বললাম, চা করো। চা খাব। চা খেয়ে নুহাশ পল্লীতে চলে যাব। বজায় থাকব না।
মাঝি চা বানাচ্ছে। আমি স্বপ্ন নিয়ে ভাবছি। স্বপ্ন হচ্ছে Short time memory. কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বপ্নে কি দেখেছি তা ভুলে যাব। আমার উচিত স্বপ্নের সব খুঁটিনাটি লিখে ফেলা। লিখতে ইচ্ছা করছে না। স্বপ্নে একগাদা কাগজ বুকের ভেতর নিয়ে শুয়েছিলাম। জেগে কোনো কাগজ পেলাম না। পাওয়ার কথাও না। কাগজ খুঁজেছি এটাই হাস্যকর।