আমি বললাম, ঘটনা তো খুবই জটিল হয়ে যাচ্ছে।
নলিনী বাবু বললেন, জটিলতা অবশ্যই আছে। আমি নিজে জট খোলার অনেক চেষ্টা করেছি। তবে আমি মোটামুটি মূখ একজন মানুষ।
আমি বললাম, শান্তি জগতে আপনি পদার্থবিদ্যা পড়ান। কাজেই নিজেকে মূর্খ বলা কি ঠিক হচ্ছে?
এই জগতের আমি কিন্তু মূখ। এই জগতের আমির চিন্তা-ভাবনাও সাধারণ! তবে দুটি জগৎ নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। দুঃখ জগতে যাদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে, শান্তি জগতেও তাদের সঙ্গে আমার পরিচয়।
আমি বললাম, তা-ই যদি হয় তাহলে শান্তি জগতেও নিশ্চয়ই আপনি আমার দেখা পেয়েছেন।
জি পেয়েছি।
আমি বললাম, সে বিষয়ে বলুন।
নলিনী বাবু বললেন, আজ না। আরেক দিন বলব। রাত দুটা বাজে। আপনি ঘুমুতে যান। আমি লক্ষ করেছি, আপনি ঘন ঘন হাই তুলছেন। আপনার ঘুম প্রয়োজন। আমি নিজেও ক্লান্ত।
আমি ঘুমুতে গেলাম। পরদিন ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়। খোঁজ নিয়ে জানলাম, নলিনী বাবু ভোরবেলা চলে গেছেন। ফ্ল্যাটের দারোয়ানের কাছে আমাকে লেখা একটা চিঠি রেখে গেছেন। চিঠি জোগাড় করে পড়লাম। তিনি লিখেছেন–
মহাশয়
আমার প্রণাম নিবেন। গত রাতে আপনার সঙ্গে উদ্ভট কিছু আলোচনা করেছি। আমার ধারণা, আমি আপনার শান্তি বিঘ্নিত করেছি।
আমি একজন মানসিক রোগী। বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছি। রোগের প্রকোপ প্রবল হলে আমাকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আমার ধারণা তখনই দুই জগৎ নামক উদ্ভট চিন্তা আমার মাথায় আসে। ধারণা না। ইহাই সত্য আপনার সময় নষ্ট করার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি। নিজ গুণে ক্ষমা করবেন।
ইতি
বাবু নলিনী ভট্টাচার্য।
চিঠি শেষ করে আমি মনে মনে বললাম হোলি কাউ এর আক্ষরিক অর্থ পবিত্র গাভী। আমেরিকানরা কোনো কারণে বড় ধরনের ধাক্কা খেলে পবিত্র গাভীর নমি নেয়। পড়াশোনার কারণে দীর্ঘদিন আমেরিকায় থাকতে হয়েছে বলেই হয়তো তাদের স্বভাবের খানিকটা আমার মধ্যে চলে এসেছে।
একজন মানসিক রোগীর গল্প
একজন মানসিক রোগীর গল্প কেউ মাথায় নিয়ে বসে থাকে না। আমি নিজেও থাকলাম না। আমার স্মৃতিতে নলিনী বাবু চমৎকার একজন ব্লাঁধুনি হিসেবে থেকে গেলেন। কোথাও ভালো কোনো খাবার খেলে নিজের অজান্তেই বলি, বাহ্ নলিনী বাবুর রান্না।
তাঁর লিখে রেখে যাওয়া বত্রিশটি সংস্কৃত শোকের খাতা মাঝে মধ্যে দেখি, লেখালেখিতে কোনোটার ব্যবহার করা যায় কি না। কোনোটাই ব্যবহার করতে পারিনি। তবে সংস্কৃত শ্লোকের পাশে লেখা নলিনী বাবুর টীকা পড়ে মজা পেয়েছি। শ্লোকের চেয়ে টীকাগুলি মজার। উদাহরণ
শ্লোক
অধরে স্ব মৃতং হি ঘোষিতীং
হৃদি হলাহলমেব কেবলম
অর্থ
রমণীদিগের অধরে অমৃত
কিন্তু হৃদয়ে শুধুই হলাহল বিষ।
টীকা
ভুল শ্লোক। মেয়েদের এই শ্লোকে
ছোট করা হয়েছে। তাছাড়া যার মুখে
অমৃত তার অন্তরেও থাকবে অমৃত।
হৃদয়ের অমৃতই মুখে আসে। যার
হৃদয় হলাহলপূর্ণ, তার অধরে
হলাহল থাকবে। উদাহরণ আমার
বাবা শ্রীকান্ত ভট্টাচার্য। (দুঃখ জগতের বাবা)
শীতকালের এক সন্ধ্যায় অবসর প্রকাশনীর মালিক, আমার পুরানো বন্ধুদের একজন উত্তরার বাড়িতে আমাকে দেখতে এলেন। তাঁর প্রকাশনা থেকে রানার একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বইটি সঙ্গে করে এনেছেন। নানান কথাবার্তা হচ্ছে প্রকাশকের বই প্রকাশ নিয়ে বিড়ম্বনার কথা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বললেন, আপনার কি মিরপুরের কথা মনে আছে। কি বিপাকেই না পড়েছিলাম।
মিরপুরের ঘটনা মনে পড়ল। একই সঙ্গে নলিনী বাবুও প্রবলভাবে ফিরে এলেন। কারণ ব্যাখ্যা করা উচিত।
আমি তখন শহীদুল্লাহ হলে থাকি। হাউস টিউটর। একের পর এক বই লিখে যাচ্ছি। নিষাদ নামে একটা সায়েন্স ফিকশন এই সময়ে লেখা। বিষয়বস্তু একটি যুবক একই সঙ্গে দুই জগতে বাস করছে। Parallel Universe কনসেপ্টের সায়েন্স ফিকশন। তখন খবর পেলাম মিরপুরের একটি মেয়ে এই বইটি পড়ার পর ভয়াবহ সমস্যায় পড়েছে। সে দাবি করছে, দুটি জগতে সে ঘোরাফেরা করছে। সাতদিন পার হয়েছে সে অঘুমী। ডাক্তাররা ঘুমের ইনজেকশন দিয়েও তাকে ঘুম পাড়াতে পারছেন না। ডাক্তার বলেছেন, বইটির লেখক উপস্থিত হলে তিনি এই জটিল সমস্যার সমাধান হয়তো দিতে পারবেন।
আমি একা উপস্থিত হওয়ার সাহস করলাম না। চার-পাঁচজনের একটা দল নিয়ে উপস্থিত হলাম। দলে আছেন অবসর প্রকাশনীর মালিক আলমগীর রহমান, দৈনিক বাংলার সহ-সম্পাদক সালেহ চৌধুরী, বাংলা একাডেমীর একজন কর্মকর্তা ওবায়দুল ইসলাম।
বাসায় পৌঁছে দেখি ভয়াবহ অবস্থা। ষোল-সতেরো বছরের এক তরুণী। তার চোখ রক্তবর্ণ। মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙছে। তাকে ঘিরে আছে আত্মীয়-স্বজন এবং ডাক্তার। মেয়েটার পুরোপুরি হিস্টিরিয়াগ্রস্ত অবস্থা। সে (তার নাম এখন আর মনে করতে পারছি না) আমাকে দেখে বিড়বিড় করে বলল, আপনি আমাকে বাঁচান। মেয়েটার বাবা সম্ভবত একজন ইঞ্জিনিয়ার। তিনি আমাকে দুঃখিত গলায় বললেন, এসব কী লেখেন। কেন লেখেন?
মেয়ের বাবা এবং আত্মীয়স্বজনের সামনে নিজেকে খুবই অসহায় লাগছিল। মনে হচ্ছিল আমি বইটি লিখে বিরাট অপরাধ করেছি। আলমগীর রহমান ভীতু প্রকৃতির মানুষ। বইটির প্রকাশক হিসেবে তার নাম চলে আসে কি-না এই ভেবেই হয়তো বারান্দায় চলে গেলেন। বারান্দা এবং উঠান ভর্তি পাড়ার ছেলেপুলে। তাদের দেখে তিনি শুকনা মুখে আবার ঘরে ঢুকলেন।