আমি বললাম, হু।
তোর বাবা সাধু-সন্ন্যাসীর মতো মানুষ। লোকে তখন তাকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলবে। সেটা কি ভালো হবে?
আমি বললাম, না।
ললিতা বলল, আমি ঠিক করেছি দাসী মেয়েটাকে আমি তাড়ায়ে দিব। যন্ত্রণা আমার ভালো লাগে না।
আমি বললাম, তুমি যদি তাকে তাড়ায়ে দাও আমি ছাদে উঠে ছাদ থেকে লাফ দিব।
এই সব কি বলো?
যা বললাম তাই করব।
ঐ রাক্ষসী মেয়ে তো তোমারে জাদুটোনা করেছে। জাদুটোনা ছাড়া এটা সম্ভব না। এই রাক্ষসীরে আমি কালই বিদায় কব।
বিদায় করবা না। সে আমার মা।
তাহলে আমি কে?
তুমি একটা খারাপ মেয়ে।
আমি খারাপ মেয়ে? আমি? কেন আমি খারাপ মেয়ে সেটা বলো। গোছায়ে বলো। আমি রাগ করব না। মন দিয়ে শুনব।
আমি জবাব দিলাম না। এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল বাবার চিৎকার-চেঁচামেচিতে। সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে দেখি বাবার এক হাতে একটা চ্যালা কাঠ, অন্য হাতে তিনি ললিতার চুল ধরে আছেন। তার শাড়ির সবটাই মাটিতে লুটাচ্ছে। গায়ে ব্লাউজ এবং পেটি কোট ছাড়া কিছু নেই। ললিতা নিঃশব্দে কাঁদছে। বাবা অতি নোংরা ভাষায় তাকে গালি দিচ্ছেন। বাবা বলছেন, আজ তোর কপালে মরণ আছে। তোকে নেংটা করে বাড়ি থেকে বের করে দেব। গায়ে একটা সুতা থাকবে না। নেংটা হেঁটে বাজারে গিয়ে উঠবি। ঘণ্টা হিসেবে ভাড়া খাটবি। এক ঘণ্টা একশ টাকা। সঙ্গে সঙ্গেই বুঝলাম আমি আগের কদর্য জগতে চলে গেছি। সাধুর মতো বাবার জায়গায় পিশাচ বাবার আগমনও ঘটেছে।
নলিনী বাবু আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আমি আমার এই নোংরা বাবার সঙ্গে অতি নোংরা পরিবেশে বাবার মৃত্যু পর্যন্ত ছিলাম। তারপর হঠাৎ করে ফিরে যাই অতি শান্তিময় এক ভুবনে।
আমি বললাম, এমন কি হতে পারে না যে, প্রবল ইচ্ছাপূরণ চেষ্টার কারণে আপনার ব্রেইন এসব আপনাকে দেখাচ্ছে?
নলিনী বাবু বললেন, সেই সম্ভাবনা নেই। কারণ আমার শান্তির জগতেও কঠিন কিছু বেদনা আছে। সেখানে আমার মা দাসী। বিষয়টা কখনোই কোনো সন্তানের ইচ্ছাপূরণের অংশ হতে পারে না।
আমি বললাম, কোয়ান্টাম থিওরি প্যারালাল ইউনিভার্সে কথা বলে। তাদের একটা থিওরি আছে Many world theory, সেখানে অসংখ্য সম্ভাবনার অসংখ্য জগৎ একই সঙ্গে থাকে। একটিতে আপনি সুখে আছেন। একটিতে আপনি দুঃখে আছেন এসব। কিন্তু সেখানেও এক জগৎ থেকে আরেক জগতে যাওয়া সম্ভব না। তাতে Wave function collapse করে। আপনাকে মনে হয় ঠিকমতো বুঝতে পারছি না।
নলিনী বাবু বললেন, একেবারেই যে বোঝাতে পারছি না তাও কিন্তু না। এ জগতে আমি একজন বিএসসি শিক্ষক। কিন্তু ওই জগতে আমি পদার্থবিদ্যার একজন শিক্ষক। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই।
আমি বললাম, ওই জগতের স্মৃতি যেহেতু আপনার আছে, পদার্থবিদ্যা যা শিখেছেন তার স্মৃতিও নিশ্চয়ই আছে।
নলিনী বাবু বললেন, আছে। সামান্যই আছে, তবে আছে। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন।
আমি বললাম, আমি তো কেমিস্ট্রির মানুষ। পদার্থবিদ্যার পড়াশোনা সামান্য। তারপরও বলুন মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণের সমীকরণটা কী?
নলিনী বাবু বললেন, g = v/(f sin x)
আমি বললাম, ঠিক আছে। আইরিশ পদার্থবিদ Fitz Gerald-এর সমীকরণটা কি মনে আছে?
নলিনী বাবু বললেন, মনে আছে। তিনি বস্তুর দৈর্ঘ্য তার চলার গতির সঙ্গে কীভাবে কমে তার সমীকরণ বের করেছিলেন। Michelson-Moreley পরীক্ষায় এই সমীকরণ ব্যবহার করা হয়েছিল। সমীকরণটা বলব?
না তার প্রয়োজন নাই।
এই প্রথম আমি সামান্য চিন্তিত বোধ করলাম। একজন স্কুলের বিএসসি শিক্ষকের Fitz Gerald সমীকরণ জানার কথা না। একই সঙ্গে একজন মানুষ Parallel দুই জগতে বাস করার কথাও না। বিজ্ঞান অনেক সম্ভাবনার কুপ্ত বলে। সম্ভাবনা সম্ভাবনাই। কল্পবিজ্ঞান এবং বাস্তবতা এক জিনিস না। আমি বললাম, আপনি যে দুটি জগৎ দেখছেন তাদের মধ্যে মিল এবং অমিল কী?
নলিনী বাবু বললেন, দুটি আসলে একই।
তার মানে? বুঝিয়ে বলুন। তার আগে আপনার জগৎ দুটি আলাদা করি। একটার নাম দেই দুঃখ জগৎ, যেখানে আপনার মা মারা গেছেন। আর একটার নাম দেই শান্তি জগৎ, যেখানে আপনার মা বেঁচে আছেন যেখানে একজন দাসী আপনার মা। এই দুই জগতে মিলটা কোথায়?
নলিনী বাবু বললেন, আমার বাবার কথা ধরুন। দুঃখ জগতে আমার বাবার স্ত্রী মারা যান কিংবা তাকে মেরে ফেলা হয়। শান্তি জগতেও একই ঘটনা ঘটে। তার স্ত্রী ললিতা মারা যান কিংবা তাকে মেরে ফেলা হয়।
কে তাকে মেরে ফেলে?
আমার বাবা।
আপনি তো বললেন, শান্তি জগতে আপনার বাবা অতি ভালো মানুষ। ধর্মকর্ম নিয়ে থাকেন।
শুরুতে তা-ই মনে হয়েছিল। যতই দিন যেতে লাগল আমি বুঝতে পারলাম বাবার মধ্যে বিরাট সমস্যা আছে। ধর্মকর্মের আড়ালে তিনি ভয়ঙ্কর একজন মানুষ। বাড়ির দাসীর সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে। আমি ওই দাসীর গর্ভে জন্ম নেওয়া এক ছেলে। সামাজিকতার কারণে আমার পরিচয় আমি তার বিবাহিত স্ত্রীর সন্তান। এখানে মিলটা লক্ষ করুন। দুঃখ জগতে যিনি আমার মা, তিনিই আবার শান্তি জগতেও আমার মা। দুঃখ জগতে বাবার স্ত্রী মারা যান। শান্তি জগতেও বাবার স্ত্রী মারা যান।
তিনি কীভাবে মারা যান?
ঝাঁপ দিয়ে কুয়াতে পড়েছিলেন। আমার ধারণা, বাবা তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছেন। বাবার পক্ষে অসম্ভব কিছু না। তিনি অতি ভয়ঙ্কর মানুষদের একজন। অথচ এত মিষ্টভাষী। তার মুখে সারাক্ষণ সাধু-সন্ন্যাসীদের গল্প।