তার শোবার ঘরটি চমৎকার করে সাজানো! দু’টি খাট পাশাপাশি। একটিতে টগর ঘুমিয়ে আছে। ওর গায়ে পাতলা একটা চাদর।
ও এত তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছে কেন ভাবী?
টগরের শরীরটা ভাল না জ্বর।
মিলি উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে টগরের কপালে হাত রাখল, বেশ জ্বর তো ভাবী! হাত পুড়ে যাচ্ছে।
খুব বেশি না। একশ এক।
একশ এক, কম দেখলে? ভাইয়াকে খবর দিয়েছ?
না, ওকে খবর দেইনি। সামান্য ব্যাপার নিয়ে আমি হৈচৈ করি না। ঠাণ্ডা লেগেছে, গা গরম হয়েছে। সেরে যাবে। তুমি কিছু খাবে মিলি?
না।
এক কাপ চা খাবে?
আমি চা খাই না ভাবী। চা খেলে রাতে আমার ঘুম হয় না।
রানু সহজ স্বরে বলল–চায়ের সঙ্গে ঘুমের কোনো সম্পর্ক নেই। আমার সাথে এক কাপ খাও কিছু হবে না। এসো রান্নাঘরে, মোড়া পেতে দিচ্ছি। রানু চায়ের কেতলি বসাল। মিলি তার পাশেই চুপচাপ বসে রইল। রানু বলল, গল্পটল্প কর। চুপচাপ বসে আছ কেন?
কী গল্প করব?
তোমরা যে গাড়ি কিনবে শুনেছিলাম তার কী হল?
জানি না কিছু। ও রিকভিশন্ড গাড়ি কিনতে চায় না। নতুন গাড়ি কেনার মত টাকাও বোধ হয় নেই।
বোধ হয় বলছি কেন? তুমি জানো না?
না। টাকা পয়সার ব্যাপারে। আমি ওর সঙ্গে কথা বলি না। ও নিজেও বলে না।
নাও, দেখ চায়ে চিনি হয়েছি কী না।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে মিলি রানুকে দেখতে লাগল। স্বাস্থ্য খারাপ হয়েছে কিন্তু তাতে যেন তাকে আরো সুন্দর লাগছে। কলেজে ফাস্ট ইয়ারে পড়া একটি বাচ্চা মেয়ের মত লাগছে। রানু বলল–তুমি কী কিছু বলতে চাও নাকি?
না, কী বলব?
মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছে কী একটা বলতে গিয়েও বলছি না?
মিলি ইতস্তত করে বলল ভাইয়ার মত এমন একজন ভাল মানুষকে তোমার পছন্দ হল না। কেন? এটা আমার খুব জানার ইচ্ছা। নাকি সে ভাল মানুষ না? রানু সহজভাবেই বলল, তোমার ভাই দূর থেকে খুব ভাল মানুষ। শুধু ভাল মানুষ না, খুবই ভাল মানুষ। কিন্তু কাছ থেকে না। তোমরা কেউ ওকে কাছ থেকে দেখিনি।
আমার ভাই আর আমি কাছ থেকে দেখিনি?
রানু হালকা গলায় বলল,–পাশাপাশি থাকলেই কাছ থেকে দেখা হয় না মিলি।
দু’জনই বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। এক সময় রানু বলল–আটটা বেজে গেছে, তোমার না। সাড়ে আটটায় গাড়ি ফেরত দিতে হবে?
মিলি উঠে দাঁড়াল। শোবার ঘরে গিয়ে টগরের মাথায় হাত রাখল। ঘাম দিচ্ছে। জ্বর কমে যাচ্ছে বোধ হয়। রানু তাকে সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেখতে এল। মিলির মনে হল আবহাওয়াটা কেমন অন্য রকম হয়ে গেছে। কেউ সহজ হতে পারছে না। মিলি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করবার জন্য জিজ্ঞেস করল–শাড়িটাতে আমাকে কেমন লাগছে ভাবী?
খুব একটা ভাল লাগছে না। সাদার ব্যাক গ্রাউন্ড হলুদ ফোঁটা গুটি বসন্তের মত দেখাচ্ছে। রাগ করলে না তো?
না রাগ করব কেন? তোমার কাছে যা সত্যি মনে হয়েছে তাই বলেছ। মিলি সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল। রানু বলল–খুব সাবধানে নামবে, সিঁড়িটা ভাল না। মিলি কোনো জবাব দিল না। তার চোখ ঝাপসা। অল্পতেই তার চোখে পানি আসে।
মিলিরা থাকে কলাবাগান, লেক সার্কাসে। নিজেদের বাড়ি নয়। ভাড়া বাড়ি। বাড়িটি কেনার কথা হচ্ছে। কথাবার্তা কোন পর্যায়ে আছে মিলি জানে না। মতিয়ুর এ সব ব্যাপারে তার সঙ্গে কখনো কোনো কথা বলে না। মিলির শ্বশুর একবার তাকে জিজ্ঞেস করলেন–বাড়ি কেনার কী হয়েছে। তখনি শুধু মিলি জানল বাড়ি কেনার একটা কথাবার্তা চলছে। একদিন সত্যি সত্যি কেনা হয়ে যাবে এবং তারও অনেক দিন পর হয়ত মিলি জানবে। কিংবা হয়ত জানবেই না।
মতিয়ুর বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়েছিল। তাঁর সঙ্গে খুব রোগা, চশমা পরা একজন লোক। সে ছেলেটির সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে। মিলিকে গাড়ি থেকে নামতে দেখেও সে না দেখার ভান করল। এবং আগের মতই হেসে হেসে কথা বলতে লাগল। কিন্তু লোকটি তাকিয়ে আছে মিলির দিকে। বেশ ভদ্রভাবেই তাকিয়ে আছে। চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে না। মিলির কী উচিত কাছে এগিয়ে যাওয়া? না। মতিয়ুর পছন্দ করবে না, সে তার কোনো বন্ধুর সঙ্গে মিলিকে আলাপ করিয়ে দেয় না।
ওদের বাড়িতে বাইরের পুরুষদের সঙ্গে মেয়েদের কথা বলার রেওয়াজ নেই। মতিয়ুরের একটি বোন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ফিজিক্সে অনার্স। সেও বোরকা পড়ে ক্লাসে যায়।
মিলি তার নিজের ঘরে ঢুকে গেল। ভাইয়াকে টেলিফোন করল কয়েকবার। রিং হচ্ছে, কিন্তু ধরছে না। তার মানে ভাইয়া ফেরেনি। এবং আকবরের মা টেলিফোন ধরছে না। মিলির রেখ চেপে গেল। কতক্ষণ সে না ধরে থাকবে? রিং হতে থাকুক। পাঁচবার ছবার, সাতবার, আটবার ন’বার।
হ্যালো।
কে ভাইয়া?
টেলিফোন ধরছিলে না কেন?
এইমাত্র আসলাম।
ওদের টেলিফোন ধরতে নিষেধ করে গেছ কেন?
কী বলতে চাস সেটা বল। আমি গোসল করব।
ভাইয়া শোন, আমি ভাবীর বাসায় গিয়েছিলাম।
ভাল।
সুন্দর বাসা।
সুন্দর হলে তা ভালই।
টগরের জ্বর। খুব জ্বর।
ওসমান সাহেব কিছু বললেন না। মিলি বলল–হ্যাঁলো, ভাইয়া আমার কথা শুনছ?
শুনছি।
কিছু তো বলছ না।
কী বলব?
মিলি খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল–তোমাকে একটা ছেলের কথা বলেছিলাম না, কালো মতো, ভাবীর সঙ্গে এক রিকশায় যাচ্ছিল?
হ্যাঁ বলেছিলি।
ঐ ছেলেটা ভাবীর বসার ঘরে বসেছিল।
তিনি একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন–ঐ ছেলেটার নাম আলম। ও এসেছিল আমার এখানে একটা বই নিতে। আমার সঙ্গেই ছিল এতক্ষণ। তুই ওকে দেখিসনি। শুধু শুধু কেন এত মিথ্যা বলিস?