বিকেলে মিলি তার শাড়ির ট্রাংক খুলল। কোনোটাই তার পছন্দ হল না। আচ্ছা সে কেন বেছে বেছে সব জংলি কালারগুলি পছন্দ করে? কেনার সময় মনে হয় কী অপূর্ব রঙ, কী অদ্ভুত ডিজাইন। কিন্তু কেনার পর আর তাকাতে ইচেছ করে না।
কোথাও যাচ্ছে নাকি?
হ্যাঁ।
কোথায়?
ভাইয়ের কাছে যাব। মতিয়ুর হালকা সুরে বলল,–আমি একটা লিফট দিতে পারি। এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। মিলি গম্ভীর গলায় বলল, আমার লিফট-টিফট লাগবে না। বলেই মনে হল–এটা সে বলল কেন? তাদের তো কোন ঝগড়া হয়নি। মিলি গলার স্বর বদলে বলল, দেখ তো কোন শাড়িটা পরব।
একটা পরলেই হয়। ভাইয়ের কাছে যেতে আবার এত সাজগোজ লাগে নাকি?
তাই বলে ফকিরনীর মতো যাব?
পর এই সবুজটা পর।
এমন কড়া রোদে ডার্ক কালার পরব?
বিকেলে রোদ থাকবে না।
না থাকুক। ডার্ক কালার আমাকে মানায় না। বিহারি মেয়েদের মত লাগে।
মতিয়ুর কিছু বলল না। তার মানে সে স্বীকার করে নিল যে ডার্ক কালার তাকে মানায় না। যেটা তাকে মানায় না সেটা পরতে বলার অর্থ কী? মিলির গলা ভার ভার হয়ে গেল। সে ঠিক করল কোথাও যাবে না। ঘরেই থাকবে। মিলির কোনো সিদ্ধান্তই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এটাও হল না। সে সবুজ রঙের শাড়িটা পারল এবং কিছুক্ষণের মধ্যে বদলে হলুদ ফুটি দেয়া একটা সাদা শাড়ি পরল।
ওসমান সাহেব ঘরে ছিলেন না। কোথায় গিয়েছেন কখন ফিরবেন আকবরের মা বলতে পারল না। মিলি বিরক্ত স্বরে বলল, কাল টেলিফোন করে বলে রেখেছি আমি আসব। আকবরের মা ভীত স্বরে বলল–আফা চা দিমু?
আমি চা খাই নাকি? কখন ফিরবে কিছু বলে গেছে?
জি না।
কিছুই বলেনি?
বলছে টেলিফোন বাজলে আমরা কেউ যেন না ধরি।
কেন?
আমি কই ক্যামনে?
মিলি আধঘণ্টার মত বসল। এই সময়ের মধ্যেই শোবার ঘর এবং বসার ঘর পরিষ্কার করল। আকবরের মাকে দিয়ে বাথরুম পরিষ্কার করাল। শোবার ঘরের বুক শেলফের সমস্ত বই নামিয়ে আবার নতুন করে রাখল।
লেখার টেবিল কাল যেমন গোছানো ছিল আজও তেমনই আছে। তার মানে ভাইয়া লিখতে বসেনি। সাদা কাগজে অবশ্যি কিছু কাটাকুটি আছে। মিলি পড়তে চেষ্টা করল হলুদ পাখি সবুজ বন। এইটিই আট দশ বার লেখা। কোনো নতুন গল্প বা উপন্যাসের নাম। মিলি তার ভাইয়ের কোনো লেখা ছাপা হয়ে যাবার পর আর পড়ে না। গল্পের বই তার ভাল লাগে না। কয়েক পাতা পড়বার পরই তার মাথা ধরে। শুধু চৈত্রের রাতে বইটা ছয়ত্ৰিশ পাতা পর্যন্ত পড়েছে। কারণ সেখানে একটা চরিত্র আছে নাম মিলি। সবাই বলে এটা নাকি তাকে নিয়েই লেখা; কিন্তু মিলির তা মনে হয় না। কারণ বইয়ের মিলি খুব সুন্দর। একটু বোকা। সেই মিলি অল্পতেই রাগ করে।
আকবরের মা, আমি যাচ্ছি।
বইতেন না?
খালি বাড়িতে বসে থেকে করব কী?
যাইবেন কই?
সেটা দিয়ে তুমি কী করবে? যত বাড়তি কথা। তুমি কথা কম বলবে। এত বেশি কথা বল কেন? গাড়ির ড্রাইভারও জিজ্ঞেস করল–কোথায় যাবেন? রেগে যেতে গিয়েও মিলি রাগ সামলাল। কারণ এটা নিজেদের গাড়ি নয়। মতিয়ুরের মামাতো বোনের গাড়ি। মাঝে মাঝে নিয়ে আসা হয়। আজ রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত মিলি গাড়িটা নিজের কাছে রাখতে পারবে। কিন্তু তার যাবার কোনো জায়গা নেই।
বেগম সাহেব কোন দিকে যাবেন?
নিউমার্কেটে চল।
আজ সোমবার নিউমার্কেট বন্ধ।
তোমাকে যেতে বলছি তুমি যাও। সোমবার নিউমার্কেট বন্ধ এটা তুমি জানো, আমি জানি না? মিলি গেটের সামনে গাড়ি রেখে বন্ধ নিউমার্কেটে ঢুকল। কিন্তু মাস্তান ধরনের ছেলে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এদের দিকে তাকালেই বুকের মধ্যে ধুক করে শব্দ হয়। মিলি তবু তাকাল, সব কটি ছেলে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এর মধ্যে একটি প্রায় ছফুটের মত লম্বা। নিউমার্কেট বন্ধ হলেও দু’টি ওষুধের দোকান খোলা। সে গট গট করে ঢুকাল ওষুধের দোকানে চারটি প্যারাসিটামল ও দু’টি ঘুমের ট্যাবলেট ফোনোবারবিটন কিনল। দু’টি কিনল। যাতে দোকানীর মনে কোন সন্দেহ না হয়। দু’টি করে কিনে কিনে সে একটা ক্রিমের কৌটা। ভর্তি করে ফেলেছে। কৌটাটির দিকে তাকালে তার ভয় লাগে। আবার ভালও লাগে।
বেগম সাহেব এখন কোনদিকে যাবেন?
নিউ পল্টন লাইন। গোরস্থানের পাশ দিয়ে যাও। ইরাকি গোরস্থান চেন? ঐ দিকে।
মিলির সমস্ত সিদ্ধান্তের মত এই সিদ্ধান্তও আকস্মিক! এখন সে যাচ্ছে রানুদের বাসায়। সে নিশ্চিত জানে রানুকে বাসায় পাওয়া যাবে না। আজ একটা খারাপ দিন। কাউকে আজ পাওয়া যাবে না। টেলিফোন করলে সেটা হবে রং নাম্বার। টিভির সামনে বসলে কারেন্ট চলে যাবে।
রানু ঘরেই ছিল। মিলিকে দেখে তার যতটা অবাক হবার কথা ততটা হল না। যেন মিলির এখানে আসাটা খুব স্বাভাবিক। সে রোজই আসে। কিন্তু তা তো নয়। মিলি বলল, ভাবী আমি আরো একদিন এসেছিলাম। তুমি ছিলে না।
জানি তোমার নোট পেয়েছিলাম।
আজ কিন্তু ভাবী বেশিক্ষণ থাকিব না। পাঁচ মিনিট বসব।
এত তাড়া কিসের?
ওর এক মামাতো বোনের গাড়ি নিয়ে এসেছি, সাড়ে আটটার মধ্যে ফেরত দিতে হবে। সাড়ে আটটা বাজতে দেরি আছে। তুমি আরাম করে বস। নতুন হেয়ার স্টাইল দেখছি। কেমন লাগছে ভাবী?
রানু হাসি মুখে বললঃ–একটু ছেলে ছেলে লাগছে। মিলির মুখ কালো হয়ে গেল। তাকে ছেলে ছেলে লাগছে। এটা সে নিজেও লক্ষ্য করেছে। রানু বলল–মেয়েদের চেহারা একটু ছেলে ছেলে দেখালে খারাপ লাগে না। ছেলেদের যেমন মেয়ে মেয়ে চেহারাতে ভালই লাগে অনেকটা এ রকম। মিলির মুখের অন্ধকার কাটল না। সে করুণ মুখ করে বসে রইল। রানু বলল, শোবার ঘরে চল। আমার সংসার দেখ।