মিলি।
বলুন।
আপনার কী কী সমস্যা বলুন তো?
আমার তো কোনো সমস্যা নেই। আমার ভাইয়ের অনেক রকম সমস্যা।
বলুন তার সমস্যার কথাই বলুন।
ওদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। আমার ভাই এবং ভাবী আলাদা আলাদা থাকে।
ছাড়াছাড়ি কেন হল?
ভাইয়ের একটা দোষ হচ্ছে সে সব সময় সত্যি কথা বলবে। এই জন্যেই ছাড়াছাড়ি হয়েছে!
সত্যি কথা বলার এত সমস্যা তা তো জানতাম না।
সমস্যা তো হবেই। রানু ভাবী একদিন জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা তোমার অনেক উপন্যাসে মনিকার নাম আছে। মনিকার প্রতি তোমার কোন দুর্বলতা আছে? ভাইয়া সঙ্গে সঙ্গে বলল, আছে। অনেকখানি আছে। একজন মানুষের অনেকের প্রতিই দুর্বলতা থাকতে পারে তাতে কিছু যায় আসে না।
মনিকা কে?
মনিকা হচ্ছে একটি খুব বাজে ধরনের মেয়ে।
খুব সুন্দর বুঝি?
জানি না, আমার সঙ্গে কখনো দেখা হয়নি।
তাহলে কী করে বললেন, বাজে ধরনের মেয়ে?
মিলি হাসতে হাসতে বলল, আপনি ঠিক ভাইয়ার মত তর্ক করেন।
আপনার ভাই খুব তর্ক করতে পারে বুঝি?
খুব পারে। কেউ তাকে তর্কে হারাতে পারবে না।
ভাইকে খুব পছন্দ করেন?
হ্যাঁ।
খুব পছন্দ?
হ্যাঁ খুব।
সবচেয়ে অপছন্দ করেন। কাকে।
কাউকে না।
আপনার স্বামীর কোন ব্যাপারটা আপনার সবচেয়ে খারাপ লাগে? মিলি চুপ করে রইল। দেবশৰ্মা হাসতে হাসতে বললেন, প্রতিটি মানুষেরই কিছু কিছু খারাপ দিক আছে। আপনার স্বামীরও নিশ্চয়ই আছে। আছে না?
হ্যাঁ আছে।
সেই সম্পর্কে বলুন।
সেই সম্পর্কে আমি বলতে পারব না। আমি কাউকে বলি না। আপনাকেও বলব না। আপনি ডাক্তার হন যাই হন।
ডাক্তার দেবশৰ্মা হাসিখুশি মেয়েটির গভীর মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তিনি মেয়েটির সমস্যাটি ঠিক ধরতে পারছেন না।
হোটেলে ফিরে মিলি অনেকক্ষণ। ঘুমুল। ঘুম ভাঙল বিকেলে। মতিয়ুর বেরুচ্ছে। মিলি বলল, আমি একা একা থাকিব?
হুঁ বিশ্রাম কর।
বিশ্রাম লাগবে না, আমিও যাব তোমার সাথে।
তোমার যেতে হবে না। তুমি থাক।
একা একা আমার ভয় লাগবে না?
ভয়ের কী আছে। চারদিক লোকজন।
মিলি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। হোটেলের লবিতে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ লোক চলাচল দেখল। তারপর রুমে ফিরে দীর্ঘ একটা চিঠি লিখল রানুকে। চিঠি শেষ হবার পর বালিশে মাথা রেখে অনেকক্ষণ কদল।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। তার কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। সে নেমে গেল নিচে। লবি ফ্যাকা ফাকা। রিসিপশনে এখন একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। দিনের বেলায় একটি মেয়ে থাকে। গুজরাটি মেয়ে। তার সঙ্গে বেশ খাতির হয়েছে মিলির। মেয়েটি মাথা নেড়ে নেড়ে সুন্দর গল্প করে। ইংরেজি কথাবার্তা। মিলি তার বেশির ভাগই বুঝতে পারে না। তবু খুব মাথা নাড়ে, যেন সব বুঝতে পারছে। ঐ মেয়েটি থাকলে বেশ হত। গল্প করা যেত। মিলি আবার উপরে উঠে এল। ঘর অন্ধকার। ঢুকতে ভয় লাগছে। সুইস টিপলেই বাতি জুলবে। কিন্তু বাতি জ্বালাতে ইচ্ছা করছে না। মিলি খাটে বসে রইল চুপচাপ। ঘর অন্ধকার থাকলেই তার বাচ্চাটির কথা মনে পড়ে। এখন যেমন মনে হচ্ছে। যেন সে খাটে ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎ ঘুম ভাঙল। দুবার সে ডাকল, মা মা বলে। তারপর উঠে বসল। একা একা খাট থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গেল নিচে। চিৎকার করে সে কাঁদছে কিন্তু কেউ শুনতে পারছে না। কারণ সবাই এখন একতলার ঘরে বসে ভিসি আর দেখছে। ভিসিআরো খুব একটা দুমধাড়াক্কা ছবি হচ্ছে। সবাই ছবি দেখছে। কেউ তার কান্না শুনতে পাচ্ছে না।
মিলি ছটফট করতে লাগল। মাঝে মাঝে তার এমন কষ্ট হয়। ইচ্ছা করে কোটা খুলে ঘুমের ওষুধগুলি বের করতে। না, সে খাবে না। শুধু দেখবে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে। বোতলটার দিকে তাকিয়ে থাকতেও কেন জানি ভাল লাগে। মিলি সুটকেস। খুলল। দরজার কাছে শব্দ হল। মতিয়ুর ফিরে এসেছে নাকি? মিলি উৎকৰ্ণ হয়ে রইল। না, মতিয়ুর না। মিলি বোতল বের করল। সব মিলিয়ে ছাপ্পানুটি ট্যাবলেট আছে। একটি বেশিও না কমও না। গুণে রাখা ট্যাবলেট। এখন সে আবার গুণবো। গুণতে গুণতে সে কাদবে। নিজের কথা ভেবে কাদবো। তার মেয়েটির কথা ভেবে কাঁদবে, রানু ভাবী এবং ভাইয়ের কথা ভেবে কাঁদবে। তারপর আবার বোতলটি লুকিয়ে রাখবে সুটকেসে।
মতিয়ুরের ফিরতে অনেক দেরি হল। সে পথ হারিয়ে ফেলেছিল। অচেনা শহরে একা একা অনেকক্ষণ ঘুরতে হয়েছে। সে এসে দেখল মিলি দরজা খোলা রেখে ঘুমুচ্ছে? কী সব কাণ্ড মিলির। অচেনা অজানা একটা হোটেলে দরজা খোলা রেখে কেউ ঘুমায়? অন্য কিছু হোক না জিনিসপত্র তো নিয়ে যেতে পারত। একটা সুটকেস হাতে নিয়ে নেমে গেলে কে ধরতে পারত?
রাত এগারোটায মতিয়ুর প্রথম বুঝতে পারল মিলি এক গাদা ঘুমের ওষুধ খেয়েছে। মতিয়ুরের কিছু করার ছিল না। কারোরই কিছু করার ছিল না। তবু হোটেলের লোকজন প্রচুর ছোটাছুটি করল। হাসপাতালের ডাক্তাররা রাত তিনটা পর্যন্ত চেষ্টা করলেন। কিছুই কাজে লাগল না। রাত তিনটায় মিলি ঘোলা চোখে চারদিকে তাকাল। হাত বাড়িয়ে কাউকে খুঁজতে চেষ্টা করল। বিড়বিড় করে কী যেন বলল। কাকে সে খুঁজল, কী সে বলল তা কেউ জানল না। কোন দিন জানবেও না।
প্রিয় রানু ভাবী
প্রিয় রানু ভাবী,
এর আগে তোমাকে দু’টি চিঠি দিযেছি। শুধু তোমাকে না যাদের যাদেব চিনতাম সবাইকেই দিযেছি। একটা কলকাতা থেকে, একটা এখান থেকে। কেউ জবাব দেযনি। কী করে দেবে, আমি তো কোনো ঠিকানা দেইনি।
এখন বাজছে সাড়ে পাঁচটা। চারদিক অন্ধকাব। আমি ঘরে এখনো বাতি জ্বালাইনি। অন্ধকাবে লিখছি। অন্ধকারে চিঠি লিখতে বেশ লাগে তাই না ভাবী?