না, জানি না। তবে জবাব পেতে চেষ্টা করি। অনেকেই সেটা করে না। চৈত্র মাসের রাতে হঠাৎ বাতাস এত ঠাণ্ডা হবে কেন, এই নিয়ে আমি ভাবছিলাম।
ওসমান সাহেব হাসলেন। অপলা হাসল না। কেন জানি সে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে পড়ল।
ঘুমুতে যাও অপলা।
আপনি ঘুমুবেন না?
না, আমি আরো খানিকক্ষণ বসে থাকব।
বসে বসে জটিল সব প্রশ্নের উত্তর ভাববেন?
তা বলতে পার।
তিনি সিগারেট ধরালেন। অপলা মৃদুস্বরে বলল, আপনাকে একটা সহজ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি, দেখি আপনি জবাব দিতে পারেন কী না।
কী প্রশ্ন?
আমি এখানে এসেছিলাম দু’দিন থাকিব ভেবে। কিন্তু আজ নিয়ে আট দিন হল এখানে আছি। ভেবে-টেবে বলুন তো কেন আছি? দয়া করে সত্যি কথাটা বলবেন।
আমি জানি না অপলা।
আপনি জানেন। খুব ভালই জানেন।
ঘুমুতে যাও অপলা।
না। আমি ঘুমুতে যাব না, আপনাকে আমার প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।
ওসমান সাহেব লক্ষ্য করলেন, অপলা কাঁদতে শুরু করেছে।
নিঃস্বাৰ্থ কান্না নয়। শব্দ করে শিশুদের মত কান্না।
এসো অপলা ঘরে যাই।
অপলা ফোঁপাতে ফোপাতে বলল, আমি কাল ভোরে চলে যাব। যাবার আগে জানতে চাই যে আপনি জানেন, কেন আমি এখানে এতদিন থাকলাম।
আমি জানি। জািনব না কেন? আমি যথেষ্ট বুদ্ধিমান।
বুদ্ধিমান কিন্তু হৃদয় বলে আপনার কিছু নেই। আপা ঠিকই বলেন।
ঘুমুতে যাও অপলা।
আমি যাব না। আপনি যান। আরাম করে ঘুমুন। আমি বসে থাকব। এখানে।
এ বাড়িতে কিন্তু ভূত আছে।
কেন বাজে কথা বলছেন। কেন আপনি আমাকে একটা ছোট্ট খুকি মনে করেন?
ছোট্ট খুকি মনে করি না।
টগর জেগে উঠেছে। সে ভয় পাওয়া গলায় ডাকল, খালামণি, খালামণি। অপলা ভেতরে চলে গেল। ওসমান সাহেব লক্ষ্য করলেন অপলা বেশ সহজ ভঙ্গিতেই টগরকে বাথরুম করাতে নিয়ে গেল। ছোটখাটো কথাবার্তাও বলতে লাগল। যেন একটু আগে কিছুই হয়নি।
তিনি নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তার কেন জানি মনে হতে লাগল টগরকে ঘুম পারিয়ে অপলা আবার আসবে। এ ঘরে। তিনি তার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিন্তু অপলা এল না।
ডাক্তারের সঙ্গে এ্যাপয়েন্টমেন্ট
ডাক্তারের সঙ্গে এ্যাপয়েন্টমেন্ট ভোর নটায়। আটটা থেকেই মতিয়ুর বলছে, কোনোরকম পাগলামী করবে না। যা জিজ্ঞেস করবে। জবাব দেবে। ফ্রিলি কথা বলবে। বানিয়ে বানিয়ে কিছু বলবে না। সবচেয়ে বড় কথা পাগলামী করবে না।
মিলি করুণ স্বরে বলল, আমি পাগল মানুষ কিছু পাগলামী তো করবই। সেটা উনি চিকিৎসা করে ভাল করবেন। সেই জন্যেই এত দূর আসা।
মতিয়ুর গম্ভীর হয়ে গেল। মিলি বলল, জায়গাটা আমার পছন্দ হচ্ছে, কেমন বিদেশ বিদেশ ভাব।
এটা বিদেশ, বিদেশ বিদেশ ভাব থাকবে না? তোমার কী ধারণা এটা ঢাকা?
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল এটা ঢাকা। আমি লরিতে গিয়ে ভাইয়ার নাম্বারে একটা টেলিফোন করে ফেললাম। রিং হচ্ছে কেউ ধরছে না। তখন রিসিপশনের মেয়েটা হিন্দিতে বলল, আপনি কোন নাম্বার চান?
মতিয়ুর বিরক্ত হয়ে বলল, কেন মিথ্যা কথা বলছি? তুমি ঘরেই ছিলে, কোথাও যাওনি। মিলি হেসে ফেলল।
হাসছ কেন?
মিথ্যা কথাটা কেমন করে ধরা পড়ে গেল তাই হাসছি। মজা লাগছে খুব।
মিলি সাজগোজ করতে লাগল। ফুলদানীতে হোটেল থেকে ফুল দিয়ে গেছে, সেই ফুল সে খোপায় গুজতে গুজতে বলল, সুন্দর হয়ে যাওয়া দরকার। নয়ত ডাক্তার ভাববেন বাংলাদেশের মেয়েগুলি দেখতে পচা। তাই না?
মতিয়ুর জবাব দিল না। রাগী চোখে তাকিয়ে রইল।
ডাক্তার দেবশৰ্মা বিশাল ব্যক্তি। বিশাল ব্যক্তিদের সাধারণত কোমল একটি মুখ থাকে। ইনার তাও নেই। প্রকাণ্ড একটা গোফের আড়ালে সব কোমলতা ঢাকা পড়েছে। চশমার কাঁচ এত মোটা যে চোখ দেখা যায় না। মিলি সহজভাবে বলল, কেমন আছেন ডাক্তার সাহেব?
ডাক্তার দেবমর্শ কোমল গলায় বললেন, ভাল আছি। ও আমাকে বলেছিল। আপনি বাঙালি কিন্তু আপনাকে দেখে আমার বিশ্বাস হয়নি। এখন কথা শুনে বিশ্বাস হচ্ছে।
চট করে কোন কিছু বিশ্বাস করা ঠিক না। অনেক বিদেশীরা চমৎকার বাংলা বলেন। তাছাড়া আমি নিজেও কিন্তু পুরোপুরি বাঙালি না। আমার মা ইউ পি-র মেয়ে।
মিলি হাসতে হাসতে বলল, আমি যা শুনি সব বিশ্বাস করে ফেলি। পাগল মানুষ তো। পাগল নাকি আপনি? হ্যাঁ। আমি এই জন্যই তো আপনার কাছে চিকিৎসার জন্যে এসেছি। আপনি আমাকে ভাল করে দিন
আপনি কবে থেকে পাগল হয়েছেন?
খুব ছোটবেলা থেকে। সময়টা বলুন। খুব ছোট, মানে কত ছোট? ক্লাস সিক্স থেকে।
বুঝলেন কী করে?
তা বলতে পারব না। আমরা দুভাই-বোনই ছিলাম পাগল। আমার বড় ভাইকে আপনি চিনবেন না। খুব নাম করা লেখক। আপনারা তো আর আমাদের লেখকদের বই পড়েন না, কাজেই তার নাম জানবেন না। আমাদের দেশে সবাই তাকে চেনে।
তাই নাকি?
জি আমাকে নিয়েও একটা বই লিখেছে নাম হল চৈত্রের দুপুর। এটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে আপনার চোখে ঘা হয়ে যাবে।
ডাক্তার দেবীর্শমা হোসে ফেললেন। মিলি আহত স্বরে বলল, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না তাই না?
হ্যাঁ করছি।
তা হলে হাসছেন কেন?
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সঙ্গে হাসির কোনো সম্পর্ক নেই। আপনি এত সুন্দর করে কথা বলছেন যে শুনেই আমার হাসি আসছে। ভাল কথা চৈত্রের দুপুর। বইটি আমি পড়তে চাই। আপনার সম্পর্কে জানিবার জন্যে। চোখে ঘা করবার জন্যে নয়। চা দিতে বলি?
বলুন।
ডাক্তার চা দিতে বললেন। ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে লাগলেন। মিলির ভদ্রলোককে বেশ লাগল।