তাই নাকি? জানতাম না তো। সুখে আছিস, না কষ্টে আছিস?
সুখেও না কষ্টে ও না। এখানে সব অন্য রকম। তোমাকে বোঝাতে পারব নরা। আত্মাটা আমাদের সঙ্গে থাকে না।
বলিস কী? কোথায় থাকে?
তাও জানি না। সারাক্ষণ এমন ছুটোছুটি কী জন্যে? আত্মা খুঁজে বেড়াই।
আশ্চর্য তো!
তোমার এখানে খাবার কিছু আছে? খুব ক্ষিধে পেয়েছে।
তিনি অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে খাবা-দাবার খুঁজেতে লাগলেন। খুঁজতে খুঁজতে তার মনে হল এটা স্বপ্ন। মিলি করুণ মুখে তার সামনে বসে আছে এটা একটা স্বপ্ন দৃশ্য। কাজেই ব্যস্ত হয়ে খাবার খোজা অর্থহীন। অথচ মিলি এমন করুণ ভঙ্গিতে বসে আছে যে খাবার না খুঁজেও পারা যায় না। তিনি খানিকটা গম ছাড়া কিছুই পেলেন না। তাঁর কপাল বেয়ে টপ টপ করে ঘােম পড়তে লাগল। এই গম দিয়ে তিনি কী করবেন? মিলি কিন্তু তার রোগা হাত বাড়িয়ে মুঠো মুঠো গম নিয়ে মুখে পুরছে। কচ কচ করে চিবোচ্ছে। ওসমান সাহেব জেগে উঠলেন। এ জাতীয় একটি স্বপ্ন দেখার কোনো মানে হয় না। কিন্তু অর্থহীন কিছুই তো ঘটে না পৃথিবীতে। এ রকম একটি স্বপ্ন দেখার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। ওসমান সাহেব সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। মঙ্গল গ্রহ আরো উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। আকাশ অসম্ভব পরিস্কার। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি এত পরিস্কারভাবে এর আগে তিনি দেখেননি। এই ছায়াপথ ধরেই মৃত মানুষেরা পৃথিবীতে নেমে আসে। কোথায় যেন পড়েছিলেন। বিভূতিভূষণের দেবযান-এ না। অন্য কোথাও?
তিনি সিগারেট টানতে টানতে স্বপ্নটার কথা ভাবতে লাগলেন। এর একটি লৌকিক সংখ্যা বের করা উচিত। নয়ত স্বপ্নের রেশ কাটবে না। তাকে বাকি রাতটা কেটে জাগাতে হবে। কারণ স্বপ্ন দেখে তিনি ভয় পেয়েছেন। প্রচণ্ড তৃষ্ণা বোধ হয়েছে। জেগে উঠে দেখেছেন বালিশ ঘামে ভিজে গেছে। অথচ ভয়ের কিছুই ছিল না। স্বপ্নে। অস্বাভাবিকতা যা আছে, তার সব স্বপ্নেই থাকে। তিনি শোবার ঘর থেকে ইজিচেয়ার টেনে আনলেন বারান্দায়। শীতল হাওয়া দিচ্ছে। বসে থাকতে ইচ্ছা হচ্ছে। এরা রোজ ইজি চেয়ারটা বারান্দা থেকে টেনে শোবার ঘরে নিয়ে যায় কেন? ইজি চেয়ারটা ফিট করতে কষ্ট হচ্ছে। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। খাট খািট শব্দ হচ্ছে। টগর বা অপলা জেগে উঠতে পারে। তিনি কাউকে জাগাতে চান না। এক সময় দুঃস্বপ্ন দেখলেই রানুকে ডেকে তুলতেন। রানু খুব বিরক্ত হত। মুখ বাকিয়ে বলত, তুমি একজন বয়স্ক মানুষ না? ভয়ে অস্থির হয়ে যাচ্ছ কেন? চোখে মুখে পানি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়।
স্বপ্নটা কেন দেখলাম সেটা তোমাকে বলি।
বলার দরকার কী?
তুমি না শুনলে বাকি রাতটা আমার ঘুম হবে না।
এ রকম অদ্ভুত স্বভাব কেন তোমার?
রানু ঘুম চোখে বসে থাকত। ঘন ঘন হাই তুলত। এবং তিনি অনেক সময় নিয়ে স্বপ্ন দেখার কারণ ব্যাখ্যা করতে শুরু করতেন। এক সময় ব্যাখ্যা শেষ হত। তিনি হৃষ্ট গলায় বলতেন, যুক্তিগুলি তোমার পছন্দ হয়েছে তো?
আমার পছন্দ অপছন্দ দিয়ে তো কিছু না। তোমার পছন্দ হলেই হল। তোমার কথা শেষ হয়েছে?
হুঁ।
তাহলে ঘুমুতে আসা। নাকি তোমার জন্যে বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হবে?
তিনি রানুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমুতে যেতেন। রানু যদি বলত, গরমের সময় এত ঘেষা ঘোষি করে শুতে ভাল লাগছে না। তিনি মৃদুস্বরে বলতেন, ভয়টা পুরোপুরি কাটেনি রানু।
ওসমান সাহেব ইজিচেয়ারে বসে ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললেন। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অপলা শোবার ঘর থেকে চেঁচাল–কে কে? অপলা নিশ্চয়ই তার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পায়নি–ঘুমের ঘোরেই চেঁচিয়েছে। কোন সাড়া-শব্দ না পেলে চুপ করে যাবে। কিন্তু আপলা আবার বলল, কে কে?
আমি। ঘুমাও অপলা।
আপনি বারান্দায় কী করছেন?
অপলা দরজা খুলে বেরিয়ে এল। বিড়বিড় করে বলল, যা ভয় পেয়েছি। অনেকক্ষণ ধরে আমি জেগে আছি। শুনলাম। ঘরে কী সব যেন টানাটানি করা হচ্ছে। তার পর দরজা খোলা হচ্ছে। আমি ভাবলাম চোর।
ওসমান সাহেব বললেন, কটা বাজে অপলা? অপলা অনেকক্ষণ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। সময় বলতে পারল না। অন্ধকারে ডায়াল দেখা যাচ্ছে না।
বাতি না জ্বালিয়ে বলা যাবে না। আপনার কাছে দিয়াশলাই আছে?
তিনি দিয়াশলাই জ্বালালেন, তিনটা দশ। অথচ মনে হচ্ছে ভোর। অপলা বলল, আপনি এত রাতে বারান্দায় বসে আছেন কেন?
একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি, তার পর আর ঘুম আসছে না।
কী দুঃস্বপ্ন?
তিনি আগ্রহ করে স্বপ্নের কথা বললেন। অপলা মৃদু স্বরে বলল, খুব অদ্ভুত স্বপ্নটা। তিনি বললেন,
না, অদ্ভুত না। এরকম স্বপ্ন কেন দেখেছি তা সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। অনেক দিন আগে একটা বই পড়েছিলাম।–দি ভেইল, সেখানে কিছু মানুষের কথা লেখা হয়েছে–যাদের আত্মা ঈশ্বর জমা রেখেছেন। তারা ব্যাকুল হয়ে স্বৰ্গ মর্ত্যে তাদের আত্মা খুঁজছে। গল্পটা খুব দাগ কেটেছিল। এই গল্পটিই স্বপ্নে একটু অন্যভাবে এসেছে।
মিলি আপা বসে বসে গম খাচ্ছেন এটা দেখলেন কেন?
ও খুব দুঃখী মেয়ে। অভাবি মেয়ে। ওরা দুঃখটা স্বপ্নে এই ভঙ্গিতে এসেছে। ওর প্রতি আমার খুব মমতা।
উনি কেমন আছেন?
জানি না।
জানিবার চেষ্টাও বোধ হয় করেননি।
তিনি জবাব দিলেন না। অপলা হাই তুলে বলল, শীত শীত লাগছে। আপনার লাগছে না?
লাগছে। কাছেই কোথাও শিলাবৃষ্টি হয়েছে। শীত লাগছে সেই কারণে।
আপনি পৃথিবীর সব স্বপ্নের জবাব জানেন না কী?