শুধু শুধু কেউ এ রকম হাসে?
অপলা গম্ভীর হয়ে বলল, আমি হাসি। কোনো কারণ ছাড়াই আমি হাসি এবং কাদি। আপনি ঘুমুতে যান। ইচ্ছা করলে আপনি আপনার পুত্রকেও নিতে পারেন।
বসি কিছুক্ষণ তোমার কাছে। হাসির গল্পটি বল। আমারো হাসতে ইচ্ছা করছে।
আমার আর করছে না। ঘুম পাচ্ছে।
বাবা উঠে চলে গেলেন। টগর অনেক রাত পর্যন্ত জেগে রইল। তার কেবলি মনে হতে লাগল। খালামণি এখানে এসে বদলে গেছে। তার ধারণা বাবাও সেটা জানেন। এবং তিনিও তার মতই জেগে জেগে খালামণির ব্যাপারটা ভাবেন। তাকে একদিন জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে, কেন খালামণি এ রকম করছে? পরশু দিনের আগের দিন বিকেলে খালামণি বলল, আজ নদীর পাড়ে যাব। একটা নৌকা ভাড়া করে খুব ঘুরব। দুলাভাই তৈরি হয়ে নিন। ফ্লাক্সে করে চা নিয়ে যাব। দৃশ্য দেখতে দেখতে চা খাব। বাবা বললেন, নদী তো অনেকখানি দূর। চার পঁাচ মাইল হবে।
হলে হবে। আপনি তৈরি হন। খাতা-কলম সঙ্গে নিন। হঠাৎ কোনো ভাব এসে গেলে লিখে
ফেলবেন।
ঝড় বৃষ্টি হতে পারে।
হলে হবে।
খালামণি ফ্লাক্স ভর্তি করে চা করল। কী একটা খাবার তৈরি করল। তারপর হঠাৎ মত বদলাল। গম্ভীর হয়ে বলল, দুলাভাইকে নিয়ে কোনো কাজ নেই। আমি আর তুই যাব।
বাবা কাপড় আনছে তো।
পরেছে পরুক। কাপড় পরে বসে থাকুক। চল আমরা রওনা দিয়ে দিই। সন্ধ্যার আগে ফিরতে হবে। হাতে সময় নেই।
টগর মৃদু স্বরে বলল, বাবাকে নিয়ে যাই? অপলা বিরক্ত হয়ে বলল, তুই তাহলে থাক তোর বাবার সঙ্গে। আমি চললাম। অপলা সত্যি সত্যি একা একা রওনা হয়ে গেল। বাবা পেছন থেকে ডাকল, এ্যাই অপলা, এ্যাই। খালামণি ফিরেও তাকাল না। ফ্লাক্স দোলাতে দোলাতে হন হন করে ছুটিতে লাগল। বাবা ফুলির আব্বাকে বলে দিলেন সঙ্গে যেতে। তার পর হাসি মুখে টগরকে বললেন, তোর খালার কী হয়েছে রে?
জানি না। কী হয়েছে।
রাগ নাকি?
হুঁ।
কার ওপর রাগ?
তোমার ওপর।
আমার ওপর রাগ, তো তোকে কেন নেয়নি?
আমার ওপরও রাগ।
বলিস কী। পৃথিবীর সবার ওপরই সে রাগ করেছে নাকি?
হুঁ।
বাবা খুব হাসতে লাগলেন। এতে হাসির কী আছে? বড়রা অকারণে কেন হাসে? এবং কেন মাঝে মাঝে ছোটদের মত পৃথিবীর সবার সঙ্গে রাগ করে? এসব প্রশ্নের উত্তর নেই। হয়ত বড় হলেই উত্তর জানা যাবে। কিংবা কে জানে হয়ত জানা যাবে না।
তিন দিনের জায়গায় এক সপ্তাহ হয়ে গেল। অপলার ঢাকা ফিরে যাবার কোন লক্ষণ নেই। রানু দু’টি আর্জেন্ট টেলিগ্রাফ পাঠিয়েছে। দু’টিতেই লেখা, তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। আপলার মধ্যে ফিরে যাবার কোন লক্ষণ নেই। ওসমান সাহেব বললেন, পড়াশোনা বন্ধ করে এখানে পড়ে আছ। যাওয়া উচিত না।
হ্যাঁ উচিত।
কবে যাবে? এখানকার স্কুলের একজন টিচার তোমাদের সঙ্গে যাবেন। তাকে বলে রেখেছি। কাল রওনা দিলে কেমন হয়।
আপনি যাচ্ছেন না?
আমি আরো কয়েকদিন থাকব।
তাহলে আমিও থাকব। টগরকে কারো সঙ্গে পাঠিয়ে দিন।
ঠিক বলছি তুমি!
ঠিকই বলছি।
এক রাতে ঘুম ভেঙে টগর দেখল। খালামণি কাঁদছে। সে ফিসফিস করে বলল, কী হয়েছে তোমার? অপলা ধরা গলায় বলল, জানি না। কী হয়েছে।
ওসমান সাহেব জেগে উঠলেন
অনেক রাতে ওসমান সাহেব জেগে উঠলেন।
ঘুম ভাঙলেই সময় জানতে ইচ্ছে করে। এ বাড়িতে কোনো ঘড়ি ছিল না। এখন ঘড়ি আছে। অপলার ছোট্ট লেডিস ঘড়ি। তাকে ডেকে কী জিজ্ঞেস করবেন কটা বাজে? নাকি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে সময় আঁচ করবার চেষ্টা করবেন। শেষ রাত হলে––দক্ষিণ আকাশে দেখা যাবে বৃশ্চিক নক্ষত্রমণ্ডলী যার উজ্জ্বলতম নক্ষত্রটির নাম জ্যেষ্ঠা। বৃশ্চিকের কাছেই থাকবে ধনু নক্ষত্রমালা। যার ঠিক উপরে মঙ্গল গ্রহ। এদের অবস্থান থেকে সময় বলে দেয়া খুব অসম্ভব নয়। ওসমান সাহেব বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশ। মিল্কিওয়ে দেখা যাচ্ছে। মঙ্গল গ্রহের কাছাকাছি উজ্জ্বল একটি তারা। এর নাম কী? শনি, কিন্তু এত কাছাকাছি কী শনির থাকার কথা? আকাশ সম্পর্কে এক সময় প্রচুর পড়াশোনা করেছিলেন গ্রহ-নক্ষত্র দেখামাত্র চিনতে পারতেন। এখন সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মঙ্গল গ্রহের পাশের উজ্জ্বল বস্তুটি কী?
তিনি শোবার ঘরে ফিরে এলেন। তৃষ্ণা বোধ হচ্ছে। টেবিলে পানির গ্লাস ও জগ। পরপর দুগ্লাস পানি খেলেন। কিন্তু তৃষ্ণা কমল না। বুক শুকিয়ে ঝাঁ ঝা করছে। ঘুমুনোর চেষ্টা করা অর্থহীন। ঘুম আসবে না, তিনি একটি দুঃস্বপ্ন দেখে জেগেছেন। দুঃস্বপ্নের রেশ যতক্ষণ পুরোপুরি না কাটবে ততক্ষণ ঘুমুনো যাবে না। ওসমান সাহেব ভ্রূ কুঁচকে ভাবলেন একে দুঃস্বপ্ন ভাবাটা কী হচ্ছে? একজন প্রিয় এবং পরিচিত কাউকে স্বপ্ন দেখাটা দুঃস্বপ্ন হতে পারে না।
স্বপ্নে দেখেছেন মিলিকে। স্বপ্নের চেহারাগুলি কখনো খুব স্পষ্ট হয় না। মিলিকে মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল ফুলি মেয়েটির মত। হাত পা নাড়ার ভঙ্গি অনেকটা অপলার মতো। মিলি যেন খুব ক্লান্ত। এসেছে অনেক দূরের কোনো জায়গা থেকে। অল্পক্ষণ থেকেই তাকে চলে যেতে হবে। সে বলল, ভাইয়া তুমি আমাকে চিনতে পারছি, আমি মিলি।
হ্যাঁ চিনতে পারছি।
আমি মরে গেছি, তুমি জান তো? বিষ খেয়েছিলাম
না বিষ-টিস খাসনি। চিকিৎসা হচ্ছে তোর।
উঁহু তুমি জান না একগাদা ঘুমের বড়ি খেয়ে ফেললাম।
তাই না-কী?
হ্যাঁ।
এখন কেমন আছিস?
বেশি ভাল না। সারাদিন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটোছুটি করতে হয়। বেশিক্ষণ এক জায়গায় থাকা যায় না।