ওসমান শব্দ করে হেসে উঠলেন। ভরাট গলায় হাসি।
টগরও হাসতে শুরু করল। সে যেন এই রসিকতাটা বুঝতে পেরেছে। ওসমান সাহেব বললেন, আজ তোমরা আসবে এটা কিন্তু আজি জানতাম।
বাজে কথা বলবেন না দুলাভাই।
বাজে কথা না। তোমাদের জন্য রান্না করতে বলেছি। ফুলির মাকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবে।
জানতেন তাহলে স্টেশনে থাকলেন না কেন?
সেটা অবৈজ্ঞানিক কাণ্ড হত। অবৈজ্ঞানিক কিছু তো আমি করতে পারি না। মনের কোনো খেয়ালকে খানিক প্রশ্রয় দেয়া যায় বেশি প্রশ্রয় দেয়া যায় না।
কি করে বুঝলেন আজ আমরা আসব?
তা জানি না। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনে হল। টেলিপ্যাথি বোধ হয়। দু’জন আসবে সেটা বুঝিনি। আমার মনে হচ্ছিল তোমরা তিনজনই আসবে।
অপলা থেমে থেমে বলল, আপাও আসত ছুটি পায়নি। তাই। বলেই আপলার মনে হল দুলাভাই যেন অন্য এক রকম ভঙ্গিতে হাসলেন। শিশুদের মিথ্যা কথা প্রশ্রয় দেবার মত ভঙ্গিতে হাসা। মিথ্যাটি না বললেই হত।
দুলাভাই, আমরা আসায় আপনি কী খুশি হয়েছেন?
হ্যাঁ।
আপনার নির্জন তপস্যায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করলাম তাই না?
তপস্যা-টপস্যা কিছু না। মহাপুরুষরা তপস্যা করেন। আমি অতি সাধারণ একজন মানুষ। যাও, গোসল কর কাপড় বদলাও। চা করতে বলেছি। ফুলির মা বাথরুমে পানি তুলে দেবে।
আপনাদের নাকি পাকা ঘাট দেয়া চমৎকার পুকুর আছে। বৃষ্টির মধ্যে সেই পুকুর সাঁতার কাটতে নাকি দারুণ মজা।
কার কাছে শুনলে?
আপার কাছে। আপা বলে দিয়েছে।
ওসমান সাহেব একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। অপলা সুন্দর একটি স্মৃতি মনে করিযে দিয়েছে। বিয়ের পর পর রানুকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন। শ্রাবণ মাসের এক দুপুরে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল সেই বৃষ্টিতে দুজনে পুকুরে নেমেছিলেন। রানু কিছুতেই নামতে চাচ্ছিল না। তিনি প্রায় জোর করে তাকে রাজি করিয়েছিলেন। তার পর সে আর উঠে আসতে চায় না। যত বার তিনি বলে, রানু চল; উঠা যাক। রানু ততবারই বলে, আর একটু, আর একটু।
সুখের উপকরণ চারদিকে ছাড়ানো থাকে। আমরা প্রায় সময়ই তা বুঝতে পারি না! হঠাৎ এক সময় তার দেখা পাই এবং অভিভূত হয়ে পড়ি।
অপলা পুকুরে গোসল করতে যাবে বলে ঠিক করল। ফুলির মা। আপত্তি করবার চেষ্টা করছে। ভর সন্ধ্যায় খোলা চুলে পুকুরে নামা ঠিক না। কিন্তু তার আপত্তি গ্রাহ্য হয়নি। টগরও তার খালামণির সঙ্গে পুকুরে নামবে। সেও নাকি সাঁতার কাটবে।
ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে। ওসমান সাহেব ছাতা মাথায় দিয়ে একটি হারিকেন হাতে পুকুর ঘাটে এসেছেন। জলে নেমেছে টগর এবং অপলা। ফুলি পানিতে পা ডুবিয়ে পুকুর ঘাটে বসে আছে। ওসমান সাহেব বললেন, বেশি দূর যেও না অপলা।
আমাকে নিয়ে ভয় নেই দুলাভাই। আমি চমৎকার সাঁতার জানি। আপনি টগরকে উঠিয়ে নিয়ে চলে যান। ওর ঠাণ্ডা লাগবে।
তুমি না উঠলে ও উঠবে না।
আমি এখানে অনেকক্ষণ থাকব। বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত উঠবে না।
ওসমান সাহেব মৃদু হাসলেন। কিছু বললেন না। বিশেষ ঘটনা কি মানুষের জীবনে বারবার ফিরে আসে? ঠিক অপলার মত গলায়। রানুও তো একদিন এই কথাই বলেছিল। সেদিন তিনি অবশ্যি রানুর পাশে ছিলেন।
আজ ছাতা মাথায় একটি কড়ই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রকৃতি কি একই ঘটনা বিভিন্ন রকমভাবে মানুষের সামনে উপস্থিত করে? এ রকম একটি ঘটনা কি আবার তাঁর জীবনে ঘটবে? অসম্ভব নয়। একদিন হয়ত টগরের ভালবাসার একটি মেয়ে এ রকম বৃষ্টির রাতে পুকুরে নামবে এবং অবিকল রানুর মত গলায় বলবে–বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত আমি উঠব না, তিনি দূর থেকে শুনে ফেলবেন।
ওসমান সাহেব মৃদু স্বরে ডাকলেন, অপলা গ্রামে বসে বসে একটা মজার জিনিস লক্ষ্য করলাম। কি সেটা? গাছের যৌবন বার বার ফিরে আসে। কিন্তু মানুষের যৌবন মাত্র একবার। কথা শেষ হওয়া মাত্র জোর বৃষ্টি শুরু হল। টগর মহানন্দে হাততালি দিল।
অপলা ভেবে রেখেছিল
অপলা ভেবে রেখেছিল সে দু’দিন থাকবে, শুক্র ও শনি। খুব বেশি হলে তিন দিন। সোমবার ড. মাইতির ক্লাস। ঐ ক্লাসটি ধরতেই হবে। এ্যাবসেন্ট করলে তিনি নামের পাশে দাগ রাখেন এবং পরের দিন এমন সব প্রশ্ন করেন যার উত্তর কারোরই জানা থাকে না। প্রশ্নতেই শেষ নয় শান্ত মুখে এমন সব বলেন যা শুনলে ক্লাস ছেড়ে ছুটে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছা করে। যেমন রীতাকে একদিন বললেন, ডাক্তার যে তোমাকে হতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। তোমার হাবভাব ডাক্তারের মত নয়, বিরহী প্রেমিকের মত। বুঝতে পারছি? এখন তুমি আমাকে বল, তোমার ডান হাতের কজির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাড়টির কী নাম। উঁচু গলায় বল যেন সবাই শুনতে পায়।
রীতা কোনোমতে বলল, আমি জানি না। স্যার। বলেই সে বসে পড়ল এবং খুব ঘামতে লাগল। মাইতি স্যার বললেন, তোমাকে কিন্তু এখনো আমি বসতে বলিনি। কেউ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বসে পড়লে আমার খারাপ লাগে। কাজেই তোমাকে আমি এখন এমন প্রশ্ন করব যার উত্তর তোমার জানা আছে বলে আমার ধারণা। বল, প্ৰেম এবং ভালবাসার মধ্যে পার্থক্য কী?
ক্লাসের সবাই হো হো করে হাসতে লাগল। এই হচ্ছে মাইতি স্যার। তার ক্লাস মিস করার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু অপলা রোববার ভোরে বেশ সহজভাবেই বলল, আজ ঢাকা না গেলে কেমন হয় রে টেগরি? টগর গম্ভীর হয়ে বলল,
ভাল হয়।
কিন্তু মাইতি স্যার যে আমাকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে। সবার সামনে কাদিয়ে ছাড়বে। চিনিস তো না তাঁকে।