জিতু মিয়া পান নিয়ে এসে দরজায় ধাক্কা দিল। ওসমান সাহেব বললেন, এখন আর লাগবে না। সকালে খাব। জিতু বেচারী বৃষ্টি মাথায় হেঁটে হেঁটে পান আনতে গেছে–একটা নিয়ে খেলেই হত। কিন্তু তার উঠতে ইচ্ছা করছে না। শরীর জুড়ে আরামদায়ক একটা আসল্য।
বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। কী মাস এটা? ভাদ্র মাস না? বাংলা মাসের নামের মধ্যে ভাদ্র মাস নামটাই সবচেয়ে খারাপ। সবচে সুন্দর হল শ্রাবণ। চৈত্র নামটাও ভাল। ওসমান সাহেব হাত বাড়িয়ে শেলফ থেকে একটা বই নামালেন। পড়তে ইচ্ছে করছে না। চোখ বুলানোর জন্য নেয়া। এক সময় প্রচুর পড়তেন। রাতের পর রাত বই পড়ে কাটিয়েছেন। একবার জাম্প ইন্টু নাথিংনেস নামে একটা বই রাত তিনটায় পড়ে শেষ করলেন। তারপর নিজে চা বানিয়ে খেলেন এবং সেই বই-ই আবার গোড়া থেকে পড়তে শুরু করলেন। চমৎকার সময় ছিল সেটা। আনন্দও উল্লাসের সময়। মনে আছে একটি জাপানি ছোটগল্প একরাতে চারবার পরার পর অনুবাদ করতে বসলেন। তার সমগ্র জীবনে এই একটিই অনুবাদ কর্ম। সেই অনুবাদটি তিনি কখনো প্রকাশ করেননি। প্রকাশ না করার পেছনের যুক্তিটি ছিল ছেলেমানুষি যুক্তি আমি ঐ জাপানি লেখকের চেয়েও অনেক বড় লেখক হব। ওর গল্পের অনুবাদ আমি কেন করব?
তিনি বড় লেখক হতে পেরেছেন? অনেক গল্প-উপন্যাস লিখেছেন ঠিকই, কিন্তু বড় লেখক হতে পেরেছেন কী? কেউ তার নিজের প্রতিভার বাইরে যেতে পারে না। খুব সত্যি কথা। বাতি নিভিয়ে ওসমান সাহেব জাপানি গল্পের কথা ভাবতে শুরু করলেন–
একটা ছোট্ট শহর। সেই শহরের নিয়ম হচ্ছে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের শহরের রাস্তার পাশে পুঁতে রাখা। কোমর পর্যন্ত ঢুকানো থাকে গর্তে। শরীরটা বেরিয়ে থাকে। দিন যায়। ধীরে ধীরে এরা বদলে যেতে থাকে। এবং এক সময় এরা গাছ হয়ে যায়। এই রকম একজন অপরাধী পুরুষ ধীরে ধীরে গাছ হচ্ছে আর রোজ রাতে তার স্ত্রী আসে তার কাছে। জানতে চায় তোমার কেমন লাগছে? পুরুষটি ক্লান্ত স্বরে তার অভিজ্ঞতার কথা বলে। মেয়েটি জানতে চায়–তুমি কী এখনো আমাকে ভালবাস। পুরুষটি থেমে থেমে বলে আমি জানি না। আমি গাছ হয়ে যাচ্ছি, আমি বুঝতে পারছি না।
যখন মানুষ ছিলে তখন কী আমাকে ভালবাসতে?
একটি অসাধারণ গল্প। কিন্তু আজ এই বর্ষার রাতে তিনি এই গল্পটির কথা ভাবছেন কেন? নিজেকে কী তিনি গাছ হিসাবে ভাবছেন। রানু হচ্ছে সেই গাছের পাশে আসা মেয়েটি?
ওসমান সাহেব লক্ষ্য করলেন তার চোখ ভিজে উঠতে শুরু করেছে। গল্পটির প্রভাব। অন্য কিছু নয়। প্রতিভাবান জাপানি গল্পকার তার মধ্যে একটি বিশুদ্ধ আবেগ সৃষ্টি করেছেন। চোখ ভিজে ওঠার পেছনে রানুর কোন ভূমিকা নেই।
মিলির বয়স তেইশ
মিলির বয়স তেইশ।
রূপসী মেয়েদের যা যা থাকতে হয়, সবই মিলির আছে। গায়ের রঙ ফর্সা। গড়পড়তা মেয়েদের তুলনায় অনেকখানি লম্বা। কাটা কাটা চোখ মুখ। বা চোখের নিচে চোখে পড়ার মত কালো তিল। তবু মিলির ধারণা তার চেহারাটা খুবই সাধারণ। সাধারণ এবং বাজে। তা না হলে বিয়ে নিয়ে কোনো মেয়ের এত ঝামেলা হয়? কথাবার্তা অনেক দূর এগুবার পর পাত্রপক্ষ হঠাৎ সময় চায়। খালার অসুখ, ছেলের এক ভাই বিদেশে থাকেন— তিনি বিয়েতে আসার ছুটি পাচ্ছেন না ইত্যাদি। বিয়ে ঠিকঠাক হবার পর সময় চাওয়ার একটাই মানে। বিয়ে হবে না।
যার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত বিয়ে হল তার নাম মতিয়ুর রহমান। মোটাসোটা বেঁটে-খাটো মানুষ। নাকের নিচে হিটলারী গোফ। সিভিল সাপ্লাইয়ে কাজ করে। মিলির জন্যে খুব যে আকর্ষণীয় পাত্র তা নয়। তবু এই বিয়ে নিয়েও কত ঝামেলা। কথাবার্তা পাকা হয়ে যাবার পর দিনই ছেলের বড় ফুপা টেলিফোন করে জানালেন, ছেলে ঠিক করেছে তার ছোট বোনের বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত সে বিয়ে করবে না।
সে সময়টা মিলির খুব খারাপ কেটেছে। এমনিতেই সে রোগ। এই সব ঝামেলায় আরো রোগ হয়ে গেল। গালের হাড় বের হয়ে এল। তার চেয়েও বড় কথা মাথার চুল পড়ে যেতে শুরু করল। চিরুনী দিয়ে একটা টান দিলেই একগাদা চুল উঠে আসে। মাথা ভর্তি চুল মিলির। কিন্তু এভাবে উঠতে থাকলে মাথা ফাঁকা হয়ে যেতে বেশি দিন লাগার কথা নয়। তার দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম হত না। এ অবস্থায় এক সপ্তাহের মধ্যে হুঁট করে মিলির বিয়ে হয়ে গেল, মতিয়ুর রহমানের সঙ্গেই। এবং তখনো তার ছোট বোনের বিয়ে হয়নি। মিলির ধারণা শ্বশুর বাড়ির কেউ তাকে পছন্দ করেনি, নেহায়েত ছেলের জন্যে কোথাও কিছু পায়নি। তাই আবার তার কাছে এসেছে। কথাটা ংশিক সত্য। শ্বশুরবাড়ির অন্য কেউ তাকে পছন্দ করেনি। কিন্তু মতিয়ুর রহমান করেছিল। এবং বিয়েটা হয়েছে তার আগ্রহেই। এরকম আজগুবী কথা মিলি বিশ্বাস করে না। সে নিজেকে সুন্দর দেখানোর যত রকম প্রক্রিয়া আছে সব চালিয়ে যায়। তার ধারণা কোনোটিই তার বেলায় কোনো কাজ করে না। কাজ করলে তার বরের চোখেই পড়ত। কিন্তু পড়ে না।
সে গত পরশু সামনের দিকের এক গাদা চুল কেটে ফেলেছে। এত বড় একটা ব্যাপারও মতিয়ুরের চোখে পড়েনি। মিলি যখন বলেছে, কোন চেঞ্জ দেখতে পােচ্ছ? সে নির্লিপ্ত গলায় বলেছে।–কী চেঞ্জ?
কিছুই চোখে পড়ছে না?
না তো। কোনো কিছু চোখে পড়ার ব্যাপার আছে না কী?
মিলি বহু কষ্টে নিজেকে সামলেছে। তার ধারণা তার বরের তার প্রতি কোনো উৎসাহ নেই। এটা একটা ভয়াবহ ব্যাপার। বিয়ের দুবছরের মধ্যে কোন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এরকম হয় না। কী? ব্যাপারটা নিয়ে কারো সঙ্গে আলাপ করতে ইচ্ছা করে কিন্তু তার তেমন কোনো ভাল বন্ধু নেই।