পাচ্ছি।
কিছু বলছি না কেন?
দেখ মিলি রানুর সঙ্গে আমার বনিবনা হয়নি। আমরা আলাদা থাকছি। এখন সে যদি কোনো ছেলের সঙ্গে পরিচিত হয় তাহলে হবে। আমি এখানে কী বলব?
কিছুই বলবে না? ভাবীর সঙ্গে তোমার সেপারেশন তো এখনও হয়নি।
এখনও হয়নি। কিন্তু হবে। রানু কাগজপত্র জমা দিয়েছে। আচ্ছা মিলি আমি রাখলাম, ঘর গুছিয়ে দিয়ে যাবার জন্যে ধন্যবাদ।
শোন, ভাইয়া, আমার কথা এখনো শেষ হয়নি।
বল কী বলছি।
তুমি নাকি বাড়ি বিক্রি করে দিচ্ছ?
বাড়ি বিক্রি করবে। কেন?
কেন করবে তা আমি কী করে জানিব। আমি যা শুনলাম তোমাকে বললাম।
ভুল শুনেছিস।
কার কাছে শুনলাম সেটা জিজ্ঞেস করলে না?
না গুজব শোনায় আমার আগ্রহ নেই। মিলি আমি রাখলাম।
এত রাখি রাখি করছি কেন?
ক্ষিধে লেগেছে। ভাত খাব।
ঠিক আছে তাহলে ভাত খাবার পর আমাকে টেলিফোন করবে।
কেন কথা এখনও শেষ হয় নি?
খুব একটা ইন্টারেস্টিং গল্প তোমাকে বলব ভাইয়া। আমার এক বান্ধবীর জীবনের সত্যি ঘটনা। তুমি এটা নিয়ে একটা গল্প লিখতে পাের। তবে বান্ধবীর নাম ব্যবহার করতে পারবে না। হ্যাঁলো, ভাইয়া, আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?
পাচ্ছি।
একটু ধরে রাখ। বাবু কী জন্যে ডাকছে শুনে আসি। আচ্ছা ভাইয়া শোন, হ্যাঁলো? বাবুর ভাল নাম রেখে দিলে না তো। খুব সুন্দর দেখে তিন অক্ষরে একটা নাম দাও তো। শুরু হবে ম দিয়ে। আমার সঙ্গে মিলিয়ে রাখতে চাই।
মৌসুমী রাখ।
না মৌসুমী না। মৌসুমী সিনেমার নায়িকার নাম।
মিতুল।
ওটা তো ছেলেদের নাম।
আজকাল ছেলেদের এবং মেয়েদের একই নাম হয়।
মিতুল শব্দের মানে কী?
আমি জানি না।
বল কী, তুমি এত বড় লেখক হয়ে মিতুল শব্দের মানে জানো না?
আমি বড় লেখক তোকে বলল কে? আচ্ছা এখন রাখলাম।
তিনি টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। আকবরের মা এবং জিতু মিয়া গভীর আগ্রহে টিভি দেখছে। জীবনের সমস্ত সুখ ও আনন্দ যেন এই যন্ত্রটিতে। রানু চলে যাওয়ায় এরাই বোধ হয় সবচেয়ে খুশি।
তিনি নিজেও কি খুশি হননি? সম্পূর্ণ নিজের মত করে থাকার একটা আলাদা আনন্দ আছে। স্বাধীনতার আনন্দ। রানুর অভাব তিনি যতটা বোধ করবেন ভেবেছিলেন ততটা করছেন না, তেমন কোন শূন্যতা তার মধ্যে তৈরি হয়নি। কিন্তু হওয়া উচিত ছিল। শুধু রানু কেন টগরের জন্যও কী তিনি তেমন কোন আকর্ষণ অনুভব করেন? মনে হয় না। কাউকে ভালবাসার ক্ষমতাই বোধ হয তার নেই।
আকবরের মা বলল—ভাইজান ভাত দিব?
দাও। কী রান্না আজকে?
কই মাছ।
ওসমান সাহেব তৃপ্তি করে ভাত খেলেন। খাওয়ার শেষে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে দু’টি সিগারেট শেষ করলেন.। তাঁর পান খেতে ইচ্ছা হল। ঘরে পান ছিল না। জীতু মিয়া ছাতা মাথায় দিয়ে পান। কিনতে গেল। ওসমান সাহেবের মনে হল এই জীবনটাই বা নেহায়েত খারাপ কী। নিঃসঙ্গতারও তো এক ধরনের আনন্দ আছে। শূন্যতার মধ্যেও আছে পরিপূর্ণতা। নৈঃশব্দ্যের গান।
ভাইজান আপনার টেলিফোন।
তিনি রিং, শুনতে পেলেন। বেশ জোরেই শব্দ হচ্ছে। কিন্তু তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন না কেন? যা আমরা শুনতে চাই না। আমাদের মস্তিষ্ক সব সময় চেষ্টা করে তা যেন শুনতে না হয।
ওসমান সাহেব বললেন–আকবরের মা, তুমি বারান্দায় একটা মোড়া এনে দাও আর যে টেলিফোন করেছে তাকে বলে দাও আমি এখন ব্যস্ত, সকাল বেলা টেলিফোন করতে।
মিলা আফা ফোন করছে।
যা বলতে বললাম বল।
আমি কইছি, আপনে বারান্দায়।
অত্যন্ত বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে তিনি টেলিফোন ধরলেন–কী ব্যাপার মিলি?
ভাইয়া আমার কথা শেষ হবার আগেই তুমি খট করে টেলিফোন রেখে দিলে কেন?
কী বলতে চাস বল।
তুমি আমার সঙ্গে এমন খারাপ ব্যবহার কর কেন?
ওসমান সাহেব একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। মিলি বলল–বাবার শরীর এত খারাপ তুমি একবারও তাকে দেখতে যাওনি। পরশু দিন তিনি দুঃখ করছিলেন। আগামীকাল আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাব।
ঠিক আছে।
শোন ভাইয়া, তুমি বাবার সঙ্গে কয়েকদিন থাকবে। একা একা এই বাড়িতে পড়ে থাকার কোনো মানে আছে?
আচ্ছা সেটা দেখা যাবে।
মিলি আরো মিনিট দশেক কথা বলে টেলিফোন রাখল। ওসমান সাহেব নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। ঘুম ঘুম লাগছে, আবার শুয়ে পড়তেও ইচ্ছা হচ্ছে না। রানু যখন ছিল দু’টা পুঞ্জ জেগে থাকতেন। এখন এগারোটা বাজােতই সুমে চোখ জড়িয়ে আসে। এর অন্তর্নিহিত রহস্যটি কী?
বৃষ্টির জন্য শীত করছে। পাতলা কোনো একটা জামা গায়ে দিয়ে ঘুমুতে হবে। আলনায় তেমন কিছু নেই। কোথায় থাকতে পারে? কাবার্ডে নিশ্চয়ই নেই। কাবার্ডে থাকত রানুর কাপড় এবং কোনো কারণে তিনি কাবার্ড খুললে রানু বিরক্ত হত। কঠিন স্বরে বলত।–আমার জিনিসে হাত দিচ্ছে কেন?
মজার ব্যাপার হচ্ছে রানু তার জিনিসের কিছুই সঙ্গে নিয়ে যায়নি। আসার সময। যেমন চটের একটা হ্যাঁন্ড ব্যাগ নিয়ে এসেছিল, যাওয়ার সময়ও ঠিক সেভাবেই গিয়েছে। তিনি মনে মনে ভাবলেন, আমাদের সবার মধ্যেই নাটক করবার প্রবণতা আছে। রানুর মধ্যে সেটা হয়ত ছিল বেশি মাত্রায় নয়ত বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় নীল রঙের শাড়ি পরার দরকার ছিল না। ওসমান সাহেবের ধারণা সে এই শাড়ি পরেছে। কারণ প্রথম যখন সে এ বাড়িতে আসে তার পরনে ছিল নীল শাড়ি। কিংবা সমস্ত ব্যাপারটা কাকতালীয়ও হতে পারে। রানু হয়ত সচেতনভাবে কিছু করেনি। তিনি অন্য রকম ব্যাখ্যা করছেন। যাবার সময় গায়ে নীল শাড়ি ছিল বলেই সেই শাড়ি পরেই গিয়েছে।