এসেছিল কখন?
দুপুরের পরে, সাইন্ধ্যা পর্যন্ত ছিল। কাইল সাইন্ধ্যার সময় আপনারে থাকতে কইছে।
মিলি ওসমান সাহেবের ছোট বোন। তার স্বামী সিভিল সাপ্লাইয়ে কাজ করে এবং বেশ ভালই মাইনে পায়। ঢাকা শহরে তাদের একটি বাড়ি আছে যার দোতলাটা ভাড়া দেয়া হয়। কিন্তু মিলির মাঝে মাঝে টাকার দরকার পড়ে। ওসমান সাহেব সেই দরকারটা মেটোন। আবার হয়ত এরকম কোনো প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
আকবরের মা।
জি।
চা দাও তো। লেবু চা।
আকবরের মা অপ্রসন্ন মুখে চা বানাতে গেল। ওসমান সাহেব বাথরুমে ঢুকলেন। রানুর অভাবটা বোঝা যাচ্ছে মেঝেতে সাবান গলে পড়ে আছে। বেসিনটা নোংরা। আয়নায় সাবানের ফেনা পড়ে জালের মত নকশা তৈরি হয়েছে। আকবরের মা এবং তার ছেলের কোনো দিকেই কোনো নজর নেই। অবিশ্যি বাজার করা হচ্ছে। রোজ দুবেলা রান্না হচ্ছে। এই বা কম কী!
গোসল সেরে বেরুতে তার অনেক সময় লাগল। টেবিলে ঢেকে রাখা চা ততক্ষণে জুড়িয়ে পানি হয়ে গেছে। ওসমান সাহেব মুখ বিকৃত না করে সেই ঠাণ্ডাচা খেলেন। ঠিক এই মুহুর্তে কোন লেখালেখি করতে ইচ্ছা হচ্ছে না। তবু বসলেন লিখতে। অনেক দিন ধরে একটা লেখা ঘুরছে। মাথায়। সারাক্ষণেই ভোতা একটা যন্ত্রণা দিচ্ছে লেখাটা। দশ/বার পৃষ্ঠা লিখে ফেলতে পারলে যন্ত্রণা একটু কমবে। এক বছর হয়ে গেল যন্ত্রণাটা পুষছেন।
কিছু কিছু লেখা বড় কষ্ট দেয়। এই কষ্ট দেয়া গল্পটির জন্ম গত বর্ষায়। ময়মনসিংহ থেকে বাসে করে ঢাকায় আসছেন। বাকুনিতে চমৎকার ঘুম এসে গেল। ঘুম ভাঙল ভাওয়ালের জঙ্গলে। সন্ধ্যা হব হব করছে। বনের মাথায় চাঁদ উঠেছে। বাস চলার শব্দ ছাড়া কোথাও কোনো শব্দ নেই। সেই শব্দও এক সময় থেমে গেল। কারবুরেটরে গোলমাল। ড্রাইভার রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে খুটখাট শুরু করেছে। যাত্রীরা সব নেমে গেছে বাস ছেড়ে। ওসমান সাহেব জানালা দিয়ে মুখ বের করে বসে আছেন। বিশাল অরণ্যে বৃষ্টির মত চাঁদের আলো ঝড়ছে। শুনশান নীরবতা। মাথায় ঠিক তখন গল্পটা এল। তিনি কল্পনা করলেন এই আরণ্য ক্রমেই বড় হচ্ছে। একটির পর একটি শহর এবং নগর গ্রাস করতে শুরু করেছে। ছোট্ট একটি শহর। শুধু বাকি। অল্প কিছু লোক থাকে। সেই শহরে। প্রতি রাতেই তারা শুনতে পায় অরণ্য এগিয়ে আসছে।
গল্পটি অনেকবার লিখতে চেষ্টা করেছেন। লিখতে পারেননি। সমস্ত ব্যাপারটা মাথায় সাজানো আছে কিন্তু কলমে আসছে না। একটি লাইনও নয়। তিনি রাতের পর রাত কাগজ কলম নিয়ে বসে। কাটিয়েছেন। দুবার এ নিয়ে রানুর সঙ্গে ঝগড়া হল। রানু বলল–এই গল্পটিই যে লিখতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। অন্য গল্প লেখ। তিনি গম্ভীর গলায় উত্তর দিলেন–একটা শেষ না করে অন্য কোনো লেখায় আমি হাত দেব না।
যদি এটা লিখতে না পার তাহলে আর অন্য কিছু লিখবে না?
না।
তুমি বড় অহঙ্কারী।
এখানে অহঙ্কারের কী দেখলে?
অনেক কিছুই দেখলাম। অক্ষমতা স্বীকার না করাটাও অহঙ্কার।
ওসমান সাহেব চুপ করে রইলেন। রানু মশারি ফেলতে ফেলতে বলল, কোনো মানুষই তার প্রতিভার বাইরে যেতে পারে না।
প্রকারান্তরে বলা, তাঁর তেমন কোনো প্রতিভা নেই। থাকলে অরণ্যের সেই গল্প লিখে ফেলতে পারতেন। পুরুষদের আহত করার কৌশল মেয়েরা খুব তাড়াতাড়ি শিখে ফেলে এবং তা ব্যবহারও করে চমৎকারভাবে। কেউ তার প্রতিভার বাইরে যেতে পারে না। বইয়ের ভাষায় কয়েকটা কথা বলে রানু ঘুমুতে গেল। ঘুমিয়ে পড়ল কিছুক্ষণের মধ্যে। ওসমান সাহেব রােত তিনটা পর্যন্ত জেগে রইলেন। খাতার পাতায় শুধু কয়েক বার লেখা হল–অরণ্য এ পর্যন্তই। টগর যখন জেগে উঠে কাঁদতে শুরু করেছে তখনো তিনি ঘুমুতে যাননি। রানু টগরকে নিয়ে বাথরুম করাল। মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াল এবং খুব সহজভাবে বলল–শোবার সময় ফ্যানটা এক ঘর কমিয়ে দিও তো। যেন কিছুই হয়নি।
ওসমান সাহেব ছোট একটি নিঃশ্বাস ফেললেন। বাইরে ভালই বৃষ্টি হচ্ছে। তার থিওরি সত্যি করবার জন্যেই বোধ হয় আজ সারা রাত বৃষ্টি পড়বে।
আপনার টেলিফোন।
তিনি চমকে তাকালেন। আকবরের মা নিঃশব্দে চলাফেরা করে। মাঝে মধ্যেই তাকে চমকে দেয়। তিনি বিরক্ত স্বরে বললেন।
কার টেলিফোন?
মিলা আফার।
তার চেয়ার ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করছিল না। আকবরের মাকে বললেই সে হাতের কাছে রিসিভার এনে দেবে। কিন্তু শোবার ঘরে টেলিফোন রাখা তার পছন্দ নয়। টেলিফোন আসা মানেই হচ্ছে অপরিচিত একজন লোকের ঘরে ঢুকে পড়া। একজন অপরিচিত মানুষ রাত দুপুরে শোবার ঘরে ঢুকুক এটা তার পছন্দ নয়। কিন্তু মিলি অপরিচিত কেউ নয়।
টেলিফোন এই ঘরে আনুম?
না আমি যাচ্ছি।
ওসমান সাহেব টেলিফোনে দীর্ঘ সময় কথা বলতে পারেন না। মিলি ঠিক তার উল্টো, ঘণ্টা খানিকের আগে টেলিফোন ছাড়তে চায় না।
হ্যাঁলো ভাইয়া, কী করছ? লিখছিলে নাকি?
না।
তোমার অপেক্ষায় থেকে সারাটা দুপুর, সারাটা বিকাল এবং সারাটা সন্ধ্যা নষ্ট হল। আমি যে গিয়েছিলাম তোমাকে বলেনি?
বলেছে।
গিয়ে কী দেখি জানো? তোমাদের জিতু মিয়া সোফায় পা তুলে লাট সাহেবের মত বসে। আছে। এমন এক চড় দিয়েছি। চড়ের কথা তোমাকে বলেছে?
না।
আচ্ছা ভাইয়া, শোন, যে জন্যে তোমাকে টেলিফোন করলাম ভাবীকে গতকাল দেখলাম একটা ছেলের সঙ্গে রিকশায় করে যাচ্ছে। সুন্দর মত ছেলে। চেক চেক শার্ট গায়ে। দুজনে খুব হাত নেড়ে নেড়ে গল্প করছিল। ভাইয়া, তুমি শুনতে পাচ্ছ?