না।
একা একা থাক ভয় লাগে না।
ভয় লাগবে কেন? এটা আমার বড় খালার বাড়ি। রাতে আমি বড় খালার সঙ্গে ঘুমাই।
এটা তোমার খালার বাড়ি জানতাম না তো। আপন খালা?
রানু জবাব দিল না। আগ্রহ নিয়ে রাস্তার দিকে তাকাল। ওসমান সাহেব দেখল ক্রিম কালারের একটা গাড়ি এসে থেমেছে। প্রায় ছফুটের মত স্বাস্থ্যবান একটি তরুণ হাসি মুখে নামছে গাড়ি থেকে। খুব সম্ভব এই ছেলেটির সঙ্গে রানু বিয়েতে যাবে। রানুর দিকে তাকালেন। ছেলেটিকে ওসমান সাহেব আগে দেখেছেন। কিনা মনে করতে পারলেন না। দেখেছেন হযত, মানুষের চেহারা তার মনে থাকে না।
রানু ঐ ছেলেটা কে?
আমাদের দূর সম্পর্কে আত্মীয়–আলম। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার।
ওর সঙ্গে কী যাচ্ছে?
হ্যাঁ। এত প্রশ্ন করছি কেন?
তিনি অপ্রস্তুত হয়ে নিজ জায়গায় ফিরে গেলেন। আলমকে দেখে মনে হল সে ওসমান সাহেবকে দেখে খুব অবাক হয়েছে। সে তার বিস্ময় গোপন করল না। হাসি মুখে বলল, কেমন আছেন। আপনি?
ভাল। ভাল আছি।
আপনি কী আমাকে চিনেছেন? আমি রানুর মামাতো ভাই। আমার নাম আলম। রানু, কী আপনাকে আমার কথা বলেছে?
তিনি হ্যাঁ না কিছুই বললেন না। অস্পষ্টভাবে হাসলেন। যার মানে হ্যাঁও হতে পারে আবার নাও হতে পারে। আলম বলল–আমি আপনার একটা মাত্র বই পড়েছি–নাম হল গিয়ে চৈত্রের রাতে। বইটা আমার একটুও ভাল লাগেনি। আপনি রাগ করলেন না তো?
না, রাগ করিনি।
রানুকে বলেছিলাম–আমি তো বই পড়ি না। পড়তে ভালও লাগে না। উনার সবচে ভাল বইটা দাও, পড়ি। রানু ঐটা দিল।
আলম সিগারেট ধরাল। নড়েচড়ে বসল। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে একটা আলোচনায় নামতে চায়। ওসমান সাহেব শঙ্কিত বোধ করলেন। যে তার বই পছন্দ করে না তার সঙ্গে আলোচনা জমে না। কথা বলতে গেলেই মনের ওপর চাপ পড়ে।
আচ্ছা ওসমান ভাই, চৈত্রের রাতে বইটিতে নীলু। মেয়েটি শেষ মুহূর্তে এই কাণ্ডটি কেন করল?
ওসমান সাহেব জবাব দিলেন না। আলম উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথা বলতে লাগল নীলু যা করেছে তাকে কিছুতেই সমর্থন করা যায় না। আমি তো তাকে ক্ষমা করবো না। ইন ফেক্ট…. তিনি হেসে ফেললেন। আলম কথা বন্ধ করে অবাক হয়ে বলল হাসছেন কেন? ওসমান সাহেব বুলুন, উপন্যাসটি আপনার পছন্দ হয়নি তবুও নীপুর ব্যাপারে যথেষ্ট উত্তেজিত হয়েছেন। তাই হাসছি।
আলম আধা-খাওয়া সিগারেট এ্যাস্ট্রেতে গুজে নতুন সিগারেট ধরাল। অসহিষ্ণু কণ্ঠে বললঅনেক লেট করে ফেললাম আমরা। রানু বলল–টগরকে নিয়ে আসতে এত দেরি করছে কেন, বুঝছি না। সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। তার চোখে চিন্তার ছাপ। কপালে দু’টি সূক্ষ্ম ভাঁজ।
টগরকে তার কিছুক্ষণ পরই আসতে দেখা গেল। সে তার খালার কোলে ঘুমুচ্ছে। রানু বলল যাক, টগরকে সঙ্গেই নিয়ে যাব। ওসমান সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। আলম বলল–চলুন আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।
দরকার নেই কোনো।
চলুন না। এমনিতেও আমাকে সিগারেট কিনতে হবে।
আলম বড় রাস্তার মোড় পর্যন্ত এল এবং এক সময় বলল–আপনি আপনার নাম লিখে একটা বই আমাকে দেবেন। আমি আমার বন্ধুদের দেখাব।
ঠিক আছে দেব। রানুর কাছে রেখে যাব।
আপনিও চলুন না। আমাদের সঙ্গে।
না। আমি বিয়ে-টিয়েতে বিশেষ যাই না। আপনারা যান।
আপনার বাসায় আপনাকে নামিয়ে দেব।
দরকার নেই কোনো।
তিনি হাটতে শুরু করলেন। অল্প কয়েক পা হাঁটার পরই মনে হল মিমির প্যাকেটটা টগরকে দেয়া হয়নি। আলম এখনো দাঁড়িয়ে আছে। ইচ্ছা করলেই ফিরে গিয়ে তার হাতে দেয়া যায়। কিন্তু ফিরলেন না। লম্বা লম্বা পা ফেলতে লাগলেন।
আকাশে মেঘ। ঘন কালো মেঘ।
বৃষ্টি কী হবে? ভাদ্র মাসে এত মেঘ হয় আকাশে?
ওসমান সাহেব বাড়ি ফিরলেন
ওসমান সাহেব বাড়ি ফিরলেন রাত আটটায়। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মেটাবার সময় বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। তাঁর ধারণা বৃষ্টির ফোঁটা যদি ছোট হয় এবং যদি খুব কাছাকাছি হয় তাহলে বৃষ্টি থামতে দীর্ঘ সময় লাগে। ফোঁটার ধরন দেখে তার মনে হল সারা রাত বৃষ্টি হবে। এবারে খুব শুকনো ধরনের বর্ষা গেছে। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে বৃষ্টির শব্দ শোনা হয়নি। আজ হয়ত শোনা যাবে।
চার টাকা ভাড়া ঠিক করা ছিল। ওসমান সাহেব চকচকে একটা পাঁচ টাকার নোট দিয়ে মনে মনে বললেন, বৃষ্টি আসার আনন্দে তোমাকে এক টাকা বিকশিস দেয়া গেল।
বসার ঘরে টিভি চলছে। আকবরের মা এবং তার ছেলে জিতু মিয়া পা ছড়িয়ে টিভি দেখছে। তারা দেখল ওসমান সাহেব ঢুকছেন। কিন্তু কেউ গা করল না। দুজনেই ভান করল–দেখতে পায়নি। ওসমান সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন–সদর দরজা খোলা কেন আকবরের মা? আকবরের মা জবাবই দিল না। তাকিয়ে রইল।
অন্য কোনো ঘরে বাতি জ্বালাওনি কেন? যাও শোবার ঘরের বাতি জ্বালাও। টিভির সাউন্ড কমিয়ে দাও।
আকবরের মা বিরক্ত মুখে উঠে গিয়ে বাতি জ্বালাল। ওসমান সাহেব ঘরে ঢুকে দেখলেন বেশ পরিষ্কার করে বিছানা করা। লেখার টেবিলে নতুন টেবিল ক্লথ। কাচের জগে৷ পানি। পিরিচ দিয়ে ঢাকা একটা গ্ৰাস।
লেখার কাগজ। একটা লাল এবং একটা কাল বল পয়েন্ট পেন। হাতের বা পাশের বুকশেলফের বইগুলি চমৎকার করে গোছানো। শুধু তাই নয়, খাটের পাশে ছোট্ট টেবিলটায় একটা স্টেনলেস স্টিলের বাটিতে কিছুটাটকা বেলি ফুল। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন–কেউ এসেছিল আকবরের মা।
মিলা আফা আসছিল।
কিছু বলে গেছে?
বলছে কাইল আবার আসব।