রানু একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। মিলি বড় ঝামেলা করে। তার সঙ্গে টেলিফোন কথা বলা মানেই হচ্ছে সমস্তটা দিন মাটি। তাও একবারে তার কথা শেষ হবে না। টেলিফোন নামিয়ে রাখার কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার রিং করবে।
আফা আপনার চা।
শুধু চা নয়। সঙ্গে বিসকিট চানাচুর। একটা ট্রেতে করে বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে এনেছে। রুপোর টে। রানু তীক্ষু কণ্ঠে বলল, কতবার বলেছি। এই ট্রেট। কখনো বের করবে না। বলিনি?
আকবরের মা জবাব দিল না।
টগর কোথায়?
ঘুমাইতাছে।
এখন ঘুমাচ্ছে কী? এখন ঘুমাবার সময়?
নিজে নিজে গিয়া বিছানায় শুইছে। এখন গিয়া দেখি ঘুমাইতাছে। আবার ঘুমের মইধ্যে হাসে।
টগর শুয়েছে তার ছোট খাটে। আরাম করে ঘুমুচ্ছে। নিজের বাড়িতে ফিরে আসার আনন্দেই ঘুম এসে গেছে বোধ হয়। রানু, টগরের কপালে হাত রেখে উত্তাপ দেখল গা ঠাণ্ডা। সে মৃদু স্বরে ডাকল টগর, বাড়ি যাবে না? টগর জবাব দিল না। সত্যি সত্যি ঘুমুচ্ছে, ভান নয়।
আফা বাজার আসছে।
বাজার আসছে ভাল কথা, আমাকে ডাকািছ কেন?
কী রানমু কন।
রোজ দিন যা রাঁধ তাই রাধবে। আমাকে জিজ্ঞেস করছি কেন? ঘর পরিষ্কার করেছ?
জি না।
আগে ঘর ঠিকঠাক কর। এ রকম নোংরা বাড়িতে আমি দাঁড়িয়েই থাকতে পারছি না। গা ঘিন ঘিন করছে।
আকবরের মা ভয়ে ভয়ে বলল আফা আপনে দুপুরে খাইতেন না?
না। আমি দুপুবে খাব না। টগরের ঘুম ভাঙলেই চলে যাব।
বাজার দেখতেন না?
জীতু মিয়া পর্দার আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছিল। রানু বলল, কেমন আছিস তুই? দেখি এদিকে আয়, তো! জীতু মিয়া এগিয়ে এসে টপ করে পা ছুঁয়ে সালাম করল।
টগর নির্বঘ্নে ঘুমুচ্ছে। নিশ্চিন্ত আবামের ঘুম। রাণু তার পাশে কিছুক্ষণ বসল। তারপর বারান্দায গিয়ে বসল খানিক্ষণ। এখানে কিছু ফুলের টবি ছিল; দু’টি ধ্বজনীগন্ধার ঝাড় শুকিযে কাঠ হয়ে আছে। পানি-টানি দেয়া হয় না।
ওসমান সাহেব বারটার দিকে এলেন। কিছু কিছু মানুষ কখনও অবাক হয় না। তিনিও কী সে রকম? রানুকে চেযার পেতে বারান্দায় বসে থাকতে দেখে একটুও অবাক না হয়ে বললেন, কেমন আছ?
–ভাল।
টগরকে নিয়ে এসেছ?
হ্যাঁ। ঘুমুচ্ছে।
শরীর ঠিক আছে তো?
ঠিকই আছে।
তিনি লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন, তুমি আসবে জানলে ঘর-দোয়ার ঠিকঠাক করে রাখতে বলতাম। আঁস্তাকুড় বানিয়ে রেখেছে।
এদের কিছু বল না কেন?
প্রথম প্রথম বলতাম। এখন বলি না। মানুষের এক সময় সব কিছুই অভ্যেস হয়ে যায়।
কিছু কিছু জিনিস অভ্যাস হওয়া ঠিক না। নোংরামি হচ্ছে তার মধ্যে একটা।
তিনি অল্প হাসলেন। হাসি মুখেই বললেন, তুমি না এলে আজ তোমার ওখানে যেতাম। যদিও আজ বুধবার না। তবে আজকের দিনটা ইম্পর্টেন্ট। আমার একটা বই রাশিয়ান ভাষায় অনুবাদ হবে বলে খবর পাওয়া গেছে। ফাইন্যাল কিছু না অবশ্যি।
কোন বইটা?
আন্দাজ করে তো কোনটা?
রানু কিছু বলল না। ওসমান সাহেব বললেন, চা-টা কিছু খেয়েছ?
হ্যাঁ।
আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকলে কেমন হয় রানু? রাতে কোন একটি ভাল রেস্টুরেন্ট…
রানু সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বিরক্ত স্বরে বলল, মিলি টেলিফোন করেছিল। সে তার বাবুর জন্যে একটা নাম চেয়েছে আর তুমি বলেছ মাকাল নাম রাখার জন্যে, এর মানে কী?
ওসমান সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, এ রকম ক্রুয়েল রসিকতা কারো সঙ্গেই করি না। মিলি বানিয়ে বানিয়ে অনেক কিছু বলে। ওর কথা বাদ দাও। আমার প্রশ্নের জবাব দাও। থাকবে। আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত?
মিলি চুপ করে বাইল। ওসমান সাহেব বললেন, আমি কখনো তোমার কাছে বেশি কিছু চাইনি, চেয়েছি?
এত প্যাচাল প্রশ্নের দরকার নেই। যা বলতে চাও সরাসবি বল?
তিনি নরম করে বললেন, তুমি থাকবে আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত?
না। এখানে এসেছি বলেই তুমি অন্য রকম ভাবতে শুরু কবেছ। অন্য রকম ভাবার কোনো কারণ নেই। আমি যা করেছি। খুব ভেবে-চিন্তে করেছি। আমি কোনো খুকি না। হুঁট করে কিছু কাবাব বয়স আমার না।
ওসমান সাহেব অল্প হাসলেন। রানু ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, হাসছ কেন?
তোমার রাগ দেখে হাসছি। অনেকদিন রাগাতে দেখি না তোমাকে।
রানু বলল, আমি এখন উঠব। তুমি যদি তোমার ছেলেকে রাখতে চাও রাখতে পার।
না, রাখতে চাই না। মাঝরাতে তোমার জন্যে কাঁদতে শুরু করবে।
ভুলেই গিয়েছিলাম। বাচ্চাদের কান্না তো তুমি আবাবা সহ্য করতে পাব না। তোমার সূক্ষ্ম অনুভূতি আহত হয়। লেখা আটকে যায়।
লেখা আমার এমনিতেই আটকে গেছে। একটি লাইনও লিখতে পারছি না।
সাহিত্যের তো তাহলে বিরাট ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।
ওসমান সাহেব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, এখন তো আমরা দু’জন দুপ্রান্তের মানুষ। তুমি এসেছ বেড়াতে। কাজেই আমরা কী এখন সহজ ভাবে গল্প-টল্প করতে পারি না?
রানু চুপ করে রইল।
তোমার অফিস কেমন চলছে রানু?
ভালই।
চাকরি মনে ধরেছে?
মনে ধরাধরির কী আছে? চাকরি কী স্বামী নাকি যে মনে ধরতে হবে?
ওসমান সাহেব প্রায় নিশ্চিত মনে ছিলেন রাতের খাবার পর্যন্ত রানু থাকবে। কিন্তু সে থাকল না।
মিলি সেজেগুজে বেরুচ্ছিল
মিলি সেজেগুজে বেরুচ্ছিল। তার শাশুড়ি, সুরমা তাকে ডাকলেন। সুরমাব বয়স প্রায় পঞ্চাশ, কিন্তু এখনো তার মাথার চুল পাকেনি। চামড়ায় ভঁাজ পড়েনি। ভদ্রমহিলা ছোটখাটো। কথা বলেন নিচু গলায় কিন্তু যা বলেন খুব স্পষ্ট করে বলেন। তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেই এটা পরিষ্কার হয়ে যায যে তিনি এ সংসারের সর্বময় কত্রী। এবং আরো দীর্ঘদিন তার কর্তৃত্ব থাকবে।