এই প্রশ্নটি উদ্দেশ্যমূলক। রানু দেখতে চায় টগর তার বাবার কাছে যাবার কথাটি কী ভাবে বলে। কিন্তু শিশুরা খুব সাবধানী। জীবনের কিছু কিছু জটিলতা তারা ভালই বুঝতে পারে। টগর তার বাবার কাছে যাবার কথা কিছুই বলল না। চোখ মিটমিট করতে লাগল।
বলো কোথায় যাবে?
তোমার ইচ্ছা।
আমার ইচ্ছা মানে? তোমার নিজের কোনো ইচ্ছা নেই?
টগর কোনো কথা বলল না। রানু বলল, বাবার কাছে যাবে? টগর তাকিয়ে আছে তার দিকে। যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। ঠাট্টা ভাবছে হযত।
যাবে?
সে মাথা নাড়াল। রানু বলল, মাথা নাড়ােনাড়ি নয়। পরিষ্কার করে বল। যাবে?
হুঁ।
ঠিক আছে নিয়ে যাব। তোমাকে ও বাড়িতে রেখে চলে আসব। যতক্ষণ ইচ্ছা তুমি থাকবে। তারপর তোমার বাবা তোমাকে দিয়ে যাব।
টগর তাকিয়ে আছে উজ্জ্বল চোখে। শিশুরা মনের মধ্যে অনেক কিছু পুষে রাখে। বাবার কাছে যাওয়াটা যে টগরের কাছে এত বড় একটা ব্যাপার তা সে কখনো বুঝতে দেয়নি।
রানু এ বাড়িতে প্রায় ছ’মাস পড়ে এসেছে। গেটের সামনে দাঁড়িযে তার মন খারাপ হল। সব কিছু অবিকল আগের মত আছে। কিছুই বদলায় নি। সে-কী। আশা করছিল। এই ছমাসে সব বদলে যাবে?
আকবরের মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওদের রিকশা থেকে নামতে দেখছে। রানুকে দেখে সে ঠিক বিশ্বাস করতে পারেনি। কিংবা বিশ্বাস করলেও এতই হকচাকিযে গিয়েছে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। এমন সময় সে সম্বিৎ ফিরে পেল। প্ৰায পাগলের মত সিঁড়ি ভেঙে নামতে লাগল। রানুর প্রতি মুহূর্তে ভয় হচ্ছিল সে সিঁড়িতে একটি পতনের শব্দ শুনবে এবং আকবরের মা বালির বস্তার মত গড়িয়ে পড়বে। রানু, টগরের হাত ধবে দাড়িযে ছিল। টগর হাত ছাড়িয়ে ছুটে গোল সিঁড়ির দিকে। যেন এই মুহূর্তে তার মাকে প্রযোজন নেই।
ওসমান সাহেব বাসায্য নেই। রানু খানিকটা স্বস্তি বোধ করল। কী অবস্থা হয়ে আছে বাড়ির। মশারি তোলা হয়নি, ঘরময় সিগারেটের ছাই। এক গাদা বই বিছানায় ছড়ানো। টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। এখনো নেভানো হয়নি।
ঘরের এ অবস্থা কেন আকবরের মা?
আকবরের মা প্রশ্নটা না শোনার ভান করল।
এ ঘর কতদিন ধরে এরকম?
কালকেই পরিষ্কার করছি। একদিনে এই অবস্থা।
ও গিয়েছে কখন।
খুব ভোরে। নাস্তাও খায় নাই।
এতক্ষণ তুমি কী করছিলে? কোনো ভদ্রলোকের বাড়ি সকাল বেলা এ রকম থাকে? কী আশ্চর্য।
রানুর বিরক্তির সীমা রইল না। যদিও এ বাড়ি অপরিষ্কার থাকলে তার কিছুই যায় আসে না। তবু এ রকম একটা অবস্থা সহ্য করা মুশকিল। বাথরুমে ভেজা কাপড় ছাড়ানো। বেসিন নোং হয়ে আছে। রানু বলল, ও আসবে কখন?
আফা, কিছুই কইয়া যায় নাই।
ঘর-দোয়ার যে এরকম করে রাখি সে কিছু বলে না?
আকবরের মা চুপ করে রইল।
জীতু মিয়া কোথায়?
বাজারে গেছে।
সমস্ত ঘর আজ পরিষ্কার করবে। পানি দিয়ে মুছবে। কাঁপেট রোদে দিবে। বাথরুম পরিষ্কার করবে।
জি আইচ্ছা।
আকবরের মা হেসে ফেলল এবং সঙ্গে সঙ্গেই হাসি গোপন করার জন্যে অন্যদিকে মুখ ফেরাল। সেকি ভাবছে রানু ফিরে এসেছে? বসার ঘরে টেলিফোন বাজছে। আকবরের মা টগরকে কোলে নিয়ে ঘুরছে। রানু বিরক্ত মুখে বলল, টেলিফোন ধরছ না কেন?
টেলিফোন ধরতে আমাকে নিষেধ করছে।
কেন? নিষেধ করছে কেন?
মিলা আফা রোজ টেলিফোন করে। ভাইজান রাগ হইছে।
ছোট বোন টেলিফোন করলে রাগ করবে। কেন? এসব কী ধরনের কথা?
রানু এগিযে গিয়ে ফোন ধরল। মিলিই করেছে। মিলি অবাক হয়ে বলল, কে ভাবী?
হ্যাঁ।
তুমি এখানে কেন?
টগরকে নিয়ে এসেছি। কাঁদছিল।
তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে ভাবী, তুমি থাক কিছুক্ষণ। আমি আসছি।
আমি বেশিক্ষণ থাকব না মিলি। আমি এক্ষুণি রওনা হচ্ছি।
ঠিক আছে ভাইয়াকে দাও। তার সঙ্গে আমার খুব দরকারি কথা।
ও তো বাসায় নেই।
ভাবী শোন, ভাইয়া আমার সঙ্গে এত খারাপ ব্যবহার করে কেন?
টেলিফোন করলেই সে রিসিভার নামিয়ে রাখে। বাসায় বলে দিয়েছে। আমি টেলিফোন করলে বলতে সে বাসায় নেই। সে এরকম করছে কেন?
তোমার ভাই তুমি ভাল বলতে পারবে।
বাবুর জন্যে একটা নাম চাচ্ছি দুমাস ধরে। প্রথম অক্ষর হবে মা, এটা দিচ্ছে না। শুধু ঘুরাচ্ছে।
তার কাছ থেকে নাম দিতে হবে এমন তো কোন কথা নেই। তোমরা একটা নাম দিয়ে দাও।
তুমি বুঝতে পারছি না ভাবী,-আমি সবাইকে বলেছি আমার ভাই নাম রাখছে। এখন তার আকিকা হচ্ছে সামনের মাসে তিন তারিখে, এগারো দিন মোটে আছে।
মিলি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর পরই রানু শুনল মিলি কাঁদছে। রানু বিরক্ত স্বরে বলল, কাদছ কেন তুমি? এখানে কাদার মত কী হল? মিলি ধরা গলায় বলল, গতকাল সকাল বেলায় টেলিফোন করেছিলাম, ভাইয়া বলল, নাম রাখ মাকাল। মা দিয়ে শুরু। রানু বেশ অবাক হল। এরকম নীচ ধরনের রসিকতা করবার লোক সে নয়। এবং মিলিকে সে যথেষ্টই পছন্দ করে। তাহলে এরকম কথা বলার মানে!
রানু বলল,–মিলি, তুমি নিজে একটা সুন্দর নাম রাখ, তারপর সবাইকে বল তোমার ভাই এই নাম রেখেছে। ঠিক আছে?
আচ্ছা।
এখন তাহলে রাখি?
তুমি নিজেও আমাকে দশ বারটা নাম দিবে ভাবী। মা দিয়ে শুরু হবে। এবং তিন অক্ষরে হবে।
এত বাধ্যবাধকতা কেন? নামের মত সামান্য ব্যাপার নিয়ে এত রকম কন্ডিশন দেয়া ঠিক না।
নামে কিছু না আসলে গেলে তুমি তোমার ছেলের জন্য এত সুন্দর নাম রাখলে কেন?
আমি রাখিনি তোমার ভাইয়ের নাম।
সে তার নিজের ছেলের জন্যে রাখবে। আর আমার বাবুর জন্যে রাখবে না কেন?