ডিপথেরিয়ার মতই একটা মেমব্রেন। ফলস মেমব্রেন। কোন রকম টক্সিসিটি এখানে হয় না। আর আপনারা রাত তিনটায় ঢাকা শহরে সমস্ত লোক নিয়ে এসেছেন।
বুড়ো ডাক্তার অসম্ভব বিরক্ত হলেন। ওসমান সাহেব বললেন, পাশের রুমের মহিলার নাকি সিজারিয়ানের প্রয়োজন হয়েছে?
হ্যাঁ হয়েছে। বাচ্চার হার্ট বিট বেড়ে একশ পঞ্চাশ হয়েছে। বাচ্চা বের না করলে দারুণ মুশকিল। এখন আপনি দয়া কের লোকজন নিয়ে বাড়ি যান শান্তিতে ঘুমুতে চেষ্টা করুন। আমাদের খানিকটা রিলিজ দিন, কবি-সাহিত্যিক মানুষ আপনারা, বেশি কিছু বলাও মুশকিল।
ডাক্তার সাহেব বিরক্ত মুখেই ঘর ছেড়ে গেলেন। ওসমান সাহেবের মনে হল রানু নিশ্চয়ই বেশ ফলাও করে টগরের বাবার পরিচয় ডাক্তার সাহেবকে দিয়েছে। নয়ত ডাক্তার সাহেব কবি সাহিত্যিক। এই শব্দ ব্যবহার করতেন না। চেহারায় তাকে চেনে এমন লোকের সংখ্যা খুব বেশি না।
ওসমান সাহেব রানুর দিকে তাকালেন। সে এখন বেশ স্বাভাবিক। পান চিতাবাচ্ছে। মিলি কী পানও নিয়ে এসেছিল নাকি? ওসমান সাহেব বললেন, রানু পাশের ঘরে যে মহিলা আছে তার সঙ্গে আমি হাসপাতালে যাচ্ছি। পৌঁছে দিয়েই ফিরে আসব।
তুমি যাচ্ছ কেন?
তার হ্যাসবেন্ড খুব নার্ভাস ফিল করছে। তার ধারণা আমি থাকলে ভর্তির ব্যাপার খুব সহজ হবে।
নিজের ছেলের এত বড় অসুখে তুমি ওর কপালে হাত দিয়ে একবার টেম্পারেচার পর্যন্ত দেখনি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকেছা। আর অজানা অচেনা এক রুগীর জন্যে দরদ উথলে উঠছে?
দরদ-টারদের কোনো ব্যাপার না। একজন লোক একা একা হাসপাতালে যেতে ভয় পাচ্ছে।
সে ভয় পাচ্ছে তাতে তোমার কী?
আমার কিছুই না?
না, তোমার কিছুই না। মহাপুরুষ সাজতে যেও না। তুমি মহাপুরুষ না। সাধারণ মানুষ। লেখকরা মহাপুরুষ না।
রানুর চোঁচামেচিতে দরজার কাছে একটা ভিড় জমে গেল। তিনি ভেবে পেলেন না হঠাৎ রানুর কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেল কেন? টগর পর্যন্ত জেগে উঠেছে। ওসমান সাহেব। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। মজিদ সাহেব বারান্দায় অপেক্ষা করছিলেন। তার দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বরে বললেন চলুন যাই।
হাতে একটা কমলালেবু
হাতে একটা কমলালেবু নিয়ে টগর বসে আছে। টগরের গায়ে লাল একটা সোয়েটার। কত দ্রুতই না বড় হয়ে যাচ্ছে ছেলেটি। শিশুরা বোধ হয় সময়কে পেছনে ফেলে এগুতে থাকে।
রোদ এসে পড়েছে তার চোখে-মুখে। সে তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে। গভীর মনোযোগে কী যেন দেখছে সে।
দরজার আড়াল থেকে রানু দৃশ্যটি দেখল। এত মন দিয়ে সে কী দেখছে। রাস্তার ওপাশে পা ছড়িয়ে একটা কুকুর রোদ পোহাচ্ছে। এছাড়া দেখার মত কোথাও কিছু নেই।
এমন অদ্ভুত হচ্ছে কেন ছেলেটা? ঘুম থেকে উঠেছে ছটায়, এখন বাজে দশটা। কমলা হাতে বসে আছে, একবারও বলেনি খুলে দাও। যেন হাতে নিয়ে বসে থাকতেই আনন্দ। রানু ডাকল, টগর। সে ফিরে তাকাল এবং ফিক করে হেসে ফেলল।
কমলা খুলে দেব?
দাও।
রোদে বসে আছে কেন? একটু সরে ছায়াতে বাস।
টগর বাধ্য ছেলের মত সরে বসল। রানু কমলার খোসা ছড়াতে ছড়াতে বলল, এখন তোমার শরীর ভাল তাই না টগর?
হ্যাঁ।
নাও কমলা নাও। দেখি কাছে আসত, গা গরম কী না দেখি। না জ্বর নেই। টগর খোসা ছাড়ানো কমলা হাতে ঠিক আগের জায়গায় গিয়ে বসল। ঠিক আগের মতই তাকিয়ে রইল রাস্তার দিকে। রানু বলল, হাতে নিয়ে বসে আছ কেন খাও। খেয়ে আমাকে বল মিষ্টি না টক।
মিষ্টি।
রাস্তায় কী দেখছি তুমি?
টগর লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল। সব শিশুরাই কী এমন চমৎকার করে হাসে?
না টগর একাই এমন হাসতে পারে? কী সুন্দর টোল পড়ছে। চিবুকে।
রানু ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। টগর বলল, পানি খাব।
শোবার ঘরে অপলা চেঁচিয়ে পড়ছে। তার পড়ার ভঙ্গি ও অদ্ভুত। চেচিযে চেঁচিয়ে এবং হোেট হেঁটে না পড়লে তার নাকি পড়া মুখস্থ হয় না। কেউ যে পড়াশোনা এত সিরিয়াসলি নেয় তা রানুর জানা ছিল না। আপলার মেট্রিক বা ইন্টারমিডিয়েট রেজাল্ট এমন কিছু আহামারি নয়। কিন্তু মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় সে প্রথম হয়েছে। ক্লাসের পড়াশোনা এখনও শুরু হযনি। কিন্তু আপলার ভাবে মনে হচ্ছে সামনেই ফাইনাল। রানু বলল, টগরকে এক গ্লাস পানি এনে দে তো অপলা। দরজার পাশ থেকে রানুর নড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না। টগর রাস্তা থেকে কখন চোখ ফিরিয়ে নেয়। তাই তার দেখার ইচ্ছা।
টগর এক চুমুক পানি খেয়েই গ্লাস সরিয়ে দিল। অপলা বলল, টগর আমাকে একটা কোয়া দে তো দেখি। মিষ্টি আছে?
হ্যাঁ।
খুব মিষ্টি?
হুঁ খুব মিষ্টি।
ওয়াক থু। তেঁতুলের মত টক। তুই এটাকে বলছিস মিষ্টি। একটা চড় খাবি।
টগর খিলখিল করে হেসে উঠল। যেন এ রকম মজার কথা সে আর শোনেনি। হাসি থামিয়ে সে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, খালামণি, আমাকে কোলে নাও।
পড়া বন্ধ করে আমি এখন বাবু সাহেবকে কোলে নেই। সখা কত।
একটু নাও।
এখন না, পড়া শেষ হোক।
অপলা ভেতরে ঢুকে গেল। রানু তাকিয়ে আছে টগরের দিকে। টগরের মুখ উজ্জ্বল হয়ে আছে। অপলার সঙ্গে তার সম্পৰ্পক বেশ আন্তরিক। কিন্তু রানুর সঙ্গে নয়। রানুকে সে কী একটু ভয় করে? মার সঙ্গে তার কী কোন দূরত্ব তৈরি হয়েছে? রানু বলল, আমার কোলে উঠতে চাও? টগর লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নিচু করল। সে কী চায় নাকি? মার চেয়ে সে-কি বাবাকেই বেশি পছন্দ করে?
টগর!
উঁ।
বেড়াতে যাবে আমার সাথে?
হুঁ।
কোথায় যেতে চাও বল। তুমি যেখানে যেতে চায় সেখানেই নিয়ে যাব। বল কোথায় যাবে?