ওসমান সাহেব মৃদু স্বরে বললেন, ডাক্তারি জানবে না কেন? মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করে এসেছে।
পাস করলেই ডাক্তার হয়? হাজার হাজার ছেলে পুলে তো ল পাস করছে। ওরা পারে ওকালতী করতে? কোর্টে দাঁড়িয়ে একটা আগুমেন্ট করতে গেলেই তো প্যান্ট নষ্ট করে ফেলবে।
ওসমান সাহেব কিছু বললেন না। বাবার সঙ্গে তর্ক করা বৃথা। হৈচৈ শুরু করলেন।
অপলা এসে বলল, চাচাজান আপনাকে ভেতরে ডাকে।
কে ডাকে?
রানু আপা। বড় ডাক্তার এসেছে।
ঘুম ভেঙেছে তাহলে। আমি ভেবেছিলাম ভোর দশটার আগে তাঁর নিদ্ৰা ভঙ্গ হবে না। ওসমান তুইও আয়।
না ঠিক আছে। আপনি একাই যান। একসঙ্গে এতগুলি মানুষের ভিড় করা ঠিক হবে না।
ওসমান সাহেব বাবার খালি করা সোফায় বসলেন। পানির তৃষ্ণা হচ্ছে এখানে পানি কোথায় পাওয়া যায় কে জানে। মোটা নার্সটাকে একটি ট্রে নিয়ে যেতে দেখা গেল। ওসমান সাহেব একবার ভাবলেন তাকে জিজ্ঞেস করবেন। শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করতে পাবলেন না। বাবা হলে কড়া গলায় বলতেন, এই যে মেয়ে, ঠাণ্ডা দেখে এক গ্লাস পানি আন। গ্লাস ধুয়ে আনবে। এই বলায় কোনো রকম জড়তা থাকত না। যেন নিজের বাড়িতেই কাউকে কিছু বলছেন। একটি মানুষেবা সঙ্গে অন্য একটি মানুষের এত তফাৎ।
ওসমান সাহেব দেখলেন বাবার সেক্রেটারি মেয়েটি ছোট ছোট পাযে এগিযে আসছে। মিলির কাছে এর কথা শুনেছেন। কিন্তু দেখা হল এই প্রথম। কী যেন নাম মেয়েটির? অত্যন্ত পরিচিত চেহারা। আগে কি দেখেছেন? কোথায দেখেছেন? টিভি বা সিনেমায অভিনয-টবিনযা করে নাকি? কবলেও তার দেখাব কথা নয়। টিভি-সিনেমা তিনি দেখেন না। মেয়েটির নাম কী বেবা? না রেখা? প্রথম অক্ষরটি কী ‘ব’ না অন্য কিছু?
স্নামালিকুম।
ওযালাইকুম সালাম।
ডাক্তার সাহেব এসে দেখেছেন। টগর ভাল আছে। অক্সিজেনের নল সব খুলে ফেলা হয়েছে।
তাই নাকি?
জি।
ক্রেস্টাপেন পেনেসিলিন দেয়া হচ্ছে, দশ লাখ ইউনিট কবে। এটিএসও দেযা হয়েছে। ভয়ের কিছুই নেই। সকালের মধ্যে সে মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠবে।
আপনি এতসব জানলেন কোথেকে?
মেয়েটি লজ্জিত স্বরে বলল, জিজ্ঞেস করে জেনেছি। আচ্ছা। আপনি কী আমাকে চিনতে পাবছেন?
পারব না কেন? আপনি আমার বাবার সেক্রেটারি। মিলি আমাকে বলেছে।
মিলি আমাকে ঠিক পছন্দ করে না।
ওসমান সাহেব কিছু বললেন না। মিলিকে ব্যস্তভাবে আসতে দেখা গেল। বীথি সবে গেল। মিলি বিরক্তস্বরে বলল, এ মেয়েটে এতক্ষণ ধবে কী গুজ গুজ করছিল?
তেমন কিছু না। কথা বলছিল।
অসুখ-বিসুখের মধ্যে তার এত কী কথা?
প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে ওসমান সাহেব বললেন, টগর কেমন আছে?
ভাল ঘুমাচ্ছে। তোমাদের জন্যে খাবাব নিয়ে এসেছি। এসো।
কী এনেছিস?
স্যান্ডউইচ বানিয়ে এনেছি। চট করে আর কী পাব?
তোর বর তোর সঙ্গে আসেনি?
ও ঘুমাচ্ছিল। জাগাইনি। টগরেব সঙ্গে ওর কী সম্পৰ্পক বল? টগবের অসুখ হলেই কী আর না হলেই বা কী?
তাই বলে কাউকে কিছু না বলে চলে আসবি?
হুঁ আসব। এসো, খেতে এসো।
রানু সহজভাবেই স্যান্ডউইচ মুখে দিচ্ছে। মিলি ফ্লাক্স ভর্তি কবে চা নিয়ে এসেছে। সেই চা ঢালা হচ্ছে। উৎসবের আমেজ চারদিকে। ওসমান সাহেব চায্যের পেয়ালা হাতে নিয়ে অপলাকে বললেন, মজিদ সাহেবকে ডেকে নিয়ে আসা। বেচারা একা ঘুরঘুর করছে।
রানুর চেহারা থেকে ভয়ের ভাবটা কেটে গেছে। সে হাসতে হাসতে পাশে বসে থাকা মোটা ভদ্রমহিলাকে কী যেন বলল। তিনিও হাসতে শুরু করলেন। এখানে যারা এসেছে। এদের অনেককেই ওসমান সাহেব চেনেন না। যেমন মোটা ভদ্রমহিলা। মুখ চেনা চেনা। পারিবাবিক উৎসবে ইনি নিশ্চয়ই আসেন। চোঁদ পনেরো বছরের চশমাপরা একটু ভাবুক ভাবুক ধরনের। ছেলেকে ও দেখা যাচ্ছে একে এর আগে কোনোদিন দেখেননি, আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কেউ না নিশ্চয়ই।
অপলা এসে বলল, দুলাভাই, মজিদ সাহেব আপনাকে একটু বাইরে ডাকেন।
কেন?
জানি না কেন। আপনি একটু আসেন। ভদ্রলোক খুব আপসেট।
মজিদ সাহেব শুকনো মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে। ওসমান সাহেবকে দেখেই বললেন, কাণ্ড
দেখেছেন? এখন বলছে সিজারিয়ান করতে হবে। এতক্ষণ কিছু বলে নাই। হঠাৎ সিজারিয়ান।
তাই নাকি?
স্যার ওদের ওপর আমার ফেইথ চলে গেছে। ওর যদি সিজারিয়ান লাগেও আমি এখানে করাব না। মরে গেলেও না। আমি পিজিতে নিয়ে যাব। আপনি স্যার আমাকে একটু সাহায্য করেন।
ওসমান সাহেব অবাক হয়ে বললেন, কী সাহায্য?
আপনাকে স্যার একটু আসতে হবে আমার সাথে। আপনি সঙ্গে থাকলে বুকে হাতীর বল হয় স্যার।
তাকে অবাক করে দিয়ে মজিদ চোখ মুছতে লাগলেন। ওসমান সাহেব বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, এত নার্ভাস হচ্ছেন কেন।
নার্ভাস হচ্ছি কারণ ও বাঁচবে না।
কেমন করে বুঝলেন?
আমি বুঝতে পারছি।
মজিদ সাহেব শিশুদের মত ফুঁফিয়ে উঠলেন।
আমি যাব আপনার সঙ্গে। ভয়ের কিছু নেই। আমি আমার স্ত্রীকে বলে এক্ষুণি আসছি।
টগরের পাশে রানু বসে আছে। বুড়ো মত একজন ডাক্তার টগরের কপালে হাত দিয়ে তাপ পরীক্ষা করছেন। ওসমান সাহেব ভেতরে ঢুকতেই রানু বলল, ইনি ছেলের বাবা। খুব সম্ভব ছেলের বাবা প্রসঙ্গেই কথা হচ্ছিল। ডাক্তার সাহেব বললেন–আপনারা শুধু শুধুই ব্যস্ত হয়েছেন। ছেলে ভাল আছে। তাছাড়া আপনারা বার বার ডিপথেরিয়া ডিপথেরিয়াই বা করছেন কেন? ডিপথেরিয়া রুগী আমি আমার ক্লিনিকে কেন রাখব?
ওর কী হয়েছে?