ওসমান সাহেব বললেন, কেমন দেখছেন? ডাক্তার ছেলেটি হাসিমুখে বলল,–ভাল, ভয়ের কিছু নেই। ব্রিদিংয়ের কষ্ট হচ্ছিল মনে করে অক্সিজেন দিয়েছি। আসলে অক্সিজেনের নল দেখলেই লোকজন ভয় পায়।
রানু শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছল। ডাক্তার ছেলেটি তার দিকে তাকিয়ে সহজ স্বরে বলল, তেমনি কিছু অসুবিধা হলে তো আমি স্যারকে ডেকে আনতাম। আনতাম না?
রানু কাঁপা গলায় বলল, আপনি আপনার স্যারকে ডেকে আনুন।
কোনোই প্রয়োজন নেই।
প্রয়োজন আছে, ডেকে আনুন।
বিশ্বাস করুন দরকার হলেই আমি তাকে ডাকব।
রানু তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, আপনি বুঝতে পারছেন না, এই ছেলেটি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। ওসমান সাহেব তাকালেন রানুর দিকে। তার চোখ ভেজা। দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটি কঠিন। শিশুটিকে রক্ষার জন্যে সে যেন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। চমৎকার একটি ছবি তো। তিনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তার কোনো উপন্যাসে এরকম কোনো ছবি আছে কী? তিনি মনে করতে পারলেন না। বাইরে গাড়ির হর্ণ দিচ্ছে। মিলিরা কী এসে পড়েছে? তিনি ঘর ছেড়ে বারান্দায় এলেন।
দু’টি গাড়ি ভর্তি করে একগাদা মানুষ এসেছে। মিলি যাকে যেখানে পেয়েছে ধরে বেঁধে নিয়ে এসেছে। বাবা এসেছেন। বাবার সেক্রেটারি সুন্দরী মেয়েটি পর্যন্ত এসেছে। ওসমান সাহেব বিরক্ত হবার বদলে খুশি হলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, এতগুলি মানুষ হঠাৎ চলে আসায় একটা উৎসবের ভাব চলে এসেছে।
তার মায়ের মৃত্যুর সময়ও এরকম হল। নানান জায়গা থেকে এত মানুষজন এল যে বাড়িটি হয়ে গেল বিয়ে বাড়ির মত। সবাই মায়ের ঘরে গিয়ে খানিকক্ষণ চোখ মুছে তারপর ছড়িয়ে পড়ে সারা বাড়িতে। সবাই চেষ্টা করে মুখের ভাব যথাসম্ভব করুণ রাখতে। সেটা বেশীক্ষণ সম্ভব হয় না। পুরনো দিনের মজার মজার সব ঘটনা মনে পড়ে যায় একেক জনের। খানিকক্ষণ হাসির পর আবার দারুণ গম্ভীর হয়ে যায় সবাই।
পরিষ্কার মনে আছে, পানি আনবার জন্যে রান্নাঘরে ঢুকে ওসমান সাহেব অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছিলেন তিন-চারজন মাঝ-বয়সী মহিলাসুখী সুখী মুখে জমিয়ে গল্প করেছেন। চুলায় এক বিশাল কেতলিতে চায়ের পানি ফুটছে। টেবিলে সারি সারি চায়ের কাপ। ওসমান সাহেবকে দেখেই একজন মহিলা বললেন–চায়ের দেরি হবে। দুধ আনতে গেছে। দুধ নাই।
ওসমান সাহেব লক্ষ্য করলেন, মিলির মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। সে বোধ হয় রাস্তায় আসতে আসতে কেঁদেছে। তার চোখ লাল। নাক ফুলে আছে। মিলি তাকে দেখে এগিয়ে এসে বলল, টগরের খবর কী?
ভালই।
কে যেন বলল অক্সিজেন দিচ্ছে।
তা দিচ্ছে।
তাহলে ভাল হয় কী ভাবে? এসব কী বলছি তুমি?
ওসমান সাহেব সিগারেট ধরালেন। মিলি বলল, আরে, তুমি কেমন মানুষ? এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
কোথায় যাব?
টগরের কাছে গিয়ে বস?
বসলে কী হবে?
বসলে কী হবে মানে? নিজের ছেলের এত বড় অসুখ আর তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে আরাম করে বিড়ি সিগারেট খাবে?
বলতে বলতে মিলি কেঁদে ফেলল। মেয়েরা এত সহজে কাদিতে পারে? মানিশ রায় বলে তার এক বন্ধু একবার বলেছিল মেয়েদের সব কিছুর মধ্যে একটা লোক দেখানোর ব্যাপার আছে।
কোনো মেয়ের যদি স্বামী মরে যায়। সে কাঁদবে কিন্তু এমনভাবে কাঁদবে যেন তাকে খারাপ না দেখা যায়। কাদার মধ্যেও সে একটু আর্ট খুঁজবে।
মিলি অবশ্যি আর্ট-ফার্ট খুঁজছে না। সে বিশ্ৰী একটা ভঙ্গি করেই কাঁদছে। ওসমান সাহেব বললেন, এত কাঁদছিস কেন?
কাঁদব না?
কাঁদার মত তো কিছু হয়নি? মিলি ফোঁফাতে ফোঁফাতে বলল, সব কিছুর মূলে হচ্ছে তুমি। তোমার মধ্যে মায়া বলে কিছু নেই।
মায়ার সঙ্গে ডিপথেরিয়ার কী সম্পর্ক? ডিপথেরিয়া একটা জীবাণুঘটিত অসুখ। খুব মায়া আছে এমন একজন বাবার ছেলেরও ডিপথেরিয়া হতে পারে। তুই যা… তোর ভাবীর কাছে যা। তবে এমন হাউমাউ করে কাঁদিস না।
মিলি তীব্র কণ্ঠে বলল, কেমন করে কাঁদতে হবে? তোমার উপন্যাসের নায়িকাদের মত? ফিচ ফিচ করে?
তিনি হেসে ফেললেন। স্বল্পবুদ্ধি মানুষেরা মাঝে মাঝে বেশ মজার কথা বলে।
মিলি ঘরের দিকে চলে গেল। তার মুখ থমথম করছে। রানুর কাছে গিয়ে সে দ্বিতীয় দফায় কেঁদেকেঁটে একটা ঝামেলা করবে। ওসমান সাহেব হাঁটতে হাটতে বারান্দার শেষ মাথায় চলে গেলেন। সিগারেটটা ড্যাম্প। টানতে কষ্ট হচ্ছে।
ওসমান সাহেব লক্ষ্য করলেন, তার বাবা খুবই উৎসাহী ভঙ্গিতে হাঁটাহাঁটি করছেন। কোনো রকম ঝামেলা উপস্থিত হলে বুড়োরাই বোধ হয় সবচেয়ে উৎসাহী হয়। তাদের উত্তেজনাহীন জীবনে সাময়িক উত্তেজনার বিষয়গুলি তারা উপভোগ করেন।
বাবাকে দেখা গেল গম্ভীর হয়ে কাকে হাত নেড়ে নেড়ে কী যেন বলছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই কয়েকজন ধরাধরি করে ওয়েটিং রুম থেকে একটা সোফা বাইরে নিয়ে এল। তিনি রাজা-বাদশাদের মত মুখ করে বসলেন। এই লোকটি যে বাড়িতেই যান। সে বাড়িকেই মনে করেন নিজের বাড়ি। ওয়েটিং রুম থেকে সোফা টেনে বারান্দায় আনার কোনো দরকার ছিল না। ওয়েটিং রুমে দিব্যি বসা যেত। আর এমন যদি হয় যে তাকে বারান্দাতেই বসতে হবে তিনি বেতের চেয়ারে বসতে পারতেন। বেশ কয়েকটি বেতের চেয়ার আছে বারান্দায়। ওসমান সাহেব সিগারেট ফেলে দিয়ে বাবার কাছে এগিয়ে গেলেন। তিনি ধমকের স্বরে বললেন, এতক্ষণ কোথায় ছিলি?
এখানেই ছিলাম।
ক্লিনিকে আনার বুদ্ধি দিল কে? ক্লিনিকে কোন চিকিৎসা হয়? টাকার শ্রাদ্ধ ছাড়া কিছুই হয় না। যত বেকুবী কাণ্ডকারখানা। আসল যে ডাক্তার সে ঘুমাচ্ছে। এক চেংড়া ছেলেকে দিয়ে রেখেছে। সে এ বি সি জানে না, ডাক্তারি জানবে কী?