দুলাভাই, চা দেয়া যাবে না, চিনি নেই।
চা লাগবে না।
আপনি খবরের কাগজটা পড়ুন। টগর এসে পড়বে।
অপলা কাগজটা টেবিলে রেখে ভেতরে চলে গেল। রানু চায় না কেউ তার সামনে থাকুক। মানুষকে অপদস্ত করার ও কষ্ট দেবার সব কটি মেয়েলি অস্ত্রই সে প্রয়োগ করতে চায়।
খবরের কাগজে কোনো খবর নেই। তেরো বছরের একটি কিশোরীকে ঝিকাতলা থেকে দিনে দুপুরে অপহরণ করা হয়েছে। দু’টি ছেলে বেবি টেক্সিতে করে মেয়েটিকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। এটা কী বিশ্বাসযোগ্য? হাজার হাজার মানুষ গিজিগিজ করছে চারদিকে। একটি মেয়ের চিৎকারে লোক জমে যাবার কথা। নিশ্চয়ই কোনো প্রেমের ব্যাপার। মেয়েটি পালিয়েছে। বাবা অপহরণের মামলা করছেন।
পাশের ঘর থেকে রানুর হাসির শব্দ পাওয়া গেল। অপলাও হাসছে। ওসমান সাহেব সিগারেট ধরালেন। ঘড়ি দেখলেন। খবরের কাগজে বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপনগুলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। অবসর সময়ে বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন পড়তে তার বেশ ভাল লাগে। এর পেছনের মনস্তাত্ত্বিক কারণটি কী? কারণ কিছু নিশ্চয়ই আছে। এই যে রানু খিলখিল করে হাসছে তার পেছনে যেমন কারণ আছে, বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন পড়ার পেছনেও কারণ আছে। চার রুম। গ্রিল দেয়া বারান্দা। সার্ভেন্টস রুম ও গ্যারাজ। ভাড়া আলোচনা সাপেক্ষ। ড্রয়িং কাম ডাইনিং, দুই বেডরুম, দুই বাথরুম। ভাড়া বাইশশ টাকা অগ্রিম আবশ্যক।
দুলাভাই আপনার চা।
ওসমান সাহেব চায়ের পেয়ালার দিকে তাকালেন! দুধ চা। তিনি দুধ চা খান না। দুধ ছাড়া হালকা চা খান। রানু তা জানে। ওসমান সাহেব হাসি মুখে বললেন চিনি ছিল না বলেছিলে।
টগরের চিনি থেকে বানানো হয়েছে।
টগরের জন্য আলাদা চিনি কেনা হয়?
হ্যাঁ।
অবাক হতে গিয়েও তিনি অবাক হলেন না। সব কিছু আলাদা আলাদা করার একটা প্রবণতা রানুর আছে। বিয়ের কিছু দিন পরই রানু বলেছিল তুমি আমার সাবান ব্যবহার করছ, কেন? ওসমান সাহেব অবাক হয়ে বলেছিলেন তোমার আলাদা সাবান নাকি?
হ্যাঁ। নীল সাবানদানীতে যে সাবান সেটা আমার।
ও আচ্ছা।
তবু তার মনে থাকত না। রানুর সাবান মেখে ফেলতেন। ভুল ধরা পড়া মাত্র লজ্জাবোধ করতেন।
চা খাচ্ছেন না কেন? চা খান।
তিনি চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন অপলা চাটা ভালই বানিয়েছ।
আমি বানিয়েছি বুঝলেন কী করে?
আমি অনেক কিছু বুঝতে পারি।
আবার অনেক কিছু বুঝতেও পারেন না।
তা ঠিক আমি অনেক কিছুই বুঝতে পারি না।
অপলা একটু অবাক হল। সে ধারণা করেছিল ওসমান সাহেব তার কথায় আপত্তি করবেন। কিছু কিছু মানুষকে দেখলেই মনে হয় এরা কারো কথাই মেনে নেয় না। সব সময় কঠিন কিছু যুক্তি-তর্ক বের করে বিপক্ষের! রাশায়ী করে দেয়। যুক্তিগুলি দেয়া হয় খুব ঠাণ্ডা মাথায় গলার স্বর থাকে খাদে। মুখ থাকে হাসি হাসি কিন্তু প্রতিটি বাক্যই কেটে কেটে বসে যায়। ওসমান সাহেব কী এ রকম একজন মানুষ?
অপলা, এমন মন দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছ কেন? কী দেখছ?
অপলা লজ্জা পেয়ে উঠে দাঁড়াল। বিব্রতম্বরে বলল–আপনি বসুন আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসব। কাপড় বদলাব।
আমাকে সঙ্গ দেবার জন্য তোমাকে তাড়াতাড়ি আসার দরকার নেই। আমার একা বসে। থাকার অভ্যাস আছে। ইউ টেক ইওর টাইম।
মাথা ধরাটা এখনো যায়নি। ওসমান সাহেব দ্বিতীয় ট্যাবলেটটি গিলে ফেললেন। একা সময় কাটানো তার নিজস্ব কিছু পদ্ধতি আছে। সেগুলো কাজে লাগাতে শুরু করলেন। ঘরের প্রতিটি জিনিসের দিকে তিনি তাকবেন। এবং বেশ কিছু সময় এগুলি নিয়ে ভাববেন। এই ছোট্ট ঘরে তিনি তাঁর পদ্ধতি আগেও অনেকবার খাটিয়েছেন। প্রতিটি জিনিসই তার চেনা, তবু প্রতিবারই নতুন নতুন ডিটেইল চোখে পড়ে। যেমন আজ চোখে পড়ল শোকেসে কিছু নতুন বই এনে রাখা হয়েছে। সবই কবিতার বই। রানু কবিতা পড়ে না। এখন কী পড়তে শুরু করেছে, না উপহার পাওয়া? শোকেসে একটা তালাও লাগানো হয়েছে। খুব সম্ভব টগরের জন্যে। শোকেস ঘাটাঘাটির বয়স এখন। দেয়ালে যে ক্যালেন্ডার ঝুলছে তার পাতা উল্টানো হয়নি। এখনো দেখা যাচ্ছে জুলাই মাস এই ভুল রানু করবে না। সে এসব ব্যাপারে খুব সাবধান। কিন্তু ভুলটা করেছে। এটাকে কী সূক্ষ্ম কোনো মানসিক পরিবর্তনের লক্ষণ বলা যাবে? ওসমান সাহেব ক্যালেন্ডারের ছবিটির দিকে মন দিলেন, রানু এসে ঢুকাল তখন।
সে নিশ্চয়ই কোথাও বেরুবে। যত্ন করে সেজেছে। কালো জমিনের উপর লাল পাতা আঁকা জামদানী শাড়ি। শাড়িটার জন্যেই কী তার চেহারা বদলে গেছে, না রোগ হবার জন্যে এমন লাগছে? ওসমান সাহেব মুগ্ধ হয়ে তাকালেন। এবং মনে মনে বললেন–কিছু মেয়ে আছে যাদের রূপ সব সময় টের পাওয়া যায়।
তোমরা কোথাও যাচোচ্ছ নাকি?
হ্যাঁ বিয়েতে যাচ্ছি।
আমি তাহলে যাই?
না বস। টগর আসবে। টগরকে তুমি আজ রাতে তোমার সঙ্গে রাখবে। সকাল বেলা আমি ওকে নিয়ে আসব। অসুবিধা হবে?
না। কার বিয়ে?
আমাদের এক আত্মীয়।
রানু বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই সামনে বসল। শীতল স্বরে বললো সামনে তো এ্যাশট্রে আছে, চায়ের কাঁপে ছাই ফেলিছ কেন?
এ্যাশট্রেটা এত সুন্দর যে ছাই ফেলতে ইচ্ছা করে না। সুন্দরের মধ্যে অসুন্দর ঠিক মানায় না।
আমার সঙ্গে বড় বড় কথা বলে লাভ নেই। তোমার বড় বড় কথা অনেক শুনেছি। আর শুনতে ইচ্ছা করছে না।
তিনি দ্বিতীয় সিগারেটটি ধারালেন এবং খুব সাবধানে ছাই ফেললেন এ্যাশট্রেতে। রানুবারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। ওসমান সাহেবও এগিয়ে গেলেন–হাল্কা গলায় বললেন, এ বাড়িতে তোমার সঙ্গে পুরুষ মানুষ কেউ থাকে না?