মজিদ প্ৰায় লাফিয়ে উঠল–দ্যাটস রাইট। এক্ষুণি যাচ্ছি।
অপলা বলল, ভদ্রলোক মাথা ধরিয়ে দিয়েছেন। অবশ্যি খুবই সরল টাইপের মানুষ। তার জীবনের পুরা হিস্ট্রি আমাকে বলেছেন। আপনার উপন্যাসের জন্যে একটা চমৎকার ক্যারেকটার। ঠিক না দুলাভাই?
ওসমান সাহেব সহজ স্বরে বললেন, খুব কমন ক্যারেকটার। এ জাতীয় মানুষ প্রচুর আছে আমাদের চারপাশে। তাছাড়া এদের তুমি যতটা সরল মনে করছি ততটা না। এদের অনেকেই বোকার একটা মুখোশ পড়ে থাকে। এই মুখোশ দিয়ে প্রচুর মিথ্যা কথা বলে। সেগুলিকে তখন আর মিথ্যা বলে মনে হয় না।
অপলা তাকিয়ে রইল। ওসমান সাহেব বললেন, তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছি না, তাই না?
বিশ্বাস করব না কেন? করছি।
না, করছ না। এই লোকটির কথাই ধর, সে যে মিথ্যা বলছে তা কী টের পেয়েছ?
সে আবার কী মিথ্যা বলল?
ঐ যে বলল আত্মীয়-স্বজনদের খবর দিতে পারিনি। এটা মিথ্যা। আমি এসে দেখি, এখানে একগাদা লোকজন। সে সবাইকে সিগারেট দিচ্ছে।
ঔপন্যাসিকরা খুব ভাল ডিটেকটিভ হতে পারে বোধ হয়। এরা সব কিছু খুব তলিয়ে দেখে। ঠিক না দুলাভাই?
ওসমান সাহেব একটু অস্বস্তি বোধ করলেন। তাঁর নিজের কাছেই মনে হল অপলাকে এত কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকে ইমপ্রেস করা। এই বালিকাটিকে মুগ্ধ করবার একটি গোপন ইচ্ছা! কী তার অবচেতন মনে বাসা বেঁধে আছে? কেন আছে?
অপলা!
জি।
এখানে টেলিফোন আছে?
অফিসে আছে। দুটাকা করে দিতে হয়। এরা ভাল বিজনেস শুরু করেছে। আমি কী আসব আপনার সঙ্গে?
এসো।
আপার সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলাম। নার্সটা একগাদা কথা শুনিয়ে দিল। ইচ্ছা হচ্ছিল একটা চড় দেই।
দিলে না কেন?
অপলা অবাক হয়ে তাকাল। ওসমান সাহেবের গলার স্বরে কোন রসিকতা নেই। তিনি সত্যি সত্যি জানতে চান। অপলা মৃদু স্বরে বলল, আপনি লোকটি খুব অদ্ভুত।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
রাতে দেড়টায় টেলিফোন করা বিরক্তিকর ব্যাপার। বার বার রিং হবে কেউ ধরবে না। তারপর যখন ধরবে তখন ভয়ার্ত স্বর বের করবে–কী হয়েছে কী হয়েছে? কী হয়েছে ব্যাখ্যা করার পরও বুঝতে চাইবে না। আবার বলতে হবে। মধ্যরাতে সুসংবাদ দিয়ে কেউ ফোন করে না।
কিন্তু আশ্চৰ্য, রিং করা মাত্রই মিলি ধরল এবং সহজ স্বরে বলল–কাকে চাই?
মিলি নাকি?
হুঁ। কী ব্যাপার, ভাইয়া?
তুই এখনো ঘুমুসনি।
না, রাতে তো আমার ঘুম হয় না।
ঘুম হয় না। মানে?
হয় না মানে হয় না। মাঝে মাঝে ঘুমের ওষুধ খাই। তুমি এত রাতে কী জন্যে ফোন করেছ?
টগরের শরীরটা খারাপ। ডিপটেরিয়া। ওকে একটা ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে।
মিলি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বল,এই কথাটা তুমি এত পরে বলেছ কেন? ঠিকানা কী বল, আমি এক্ষুণি আসছি।
আসার দরকার নেই, ও ভালই আছে।
তোমাকে ঠিকানা দিতে বলছি তুমি ঠিকানা দাও।
ওসমান সাহেব ঠিকানা দিলেন। তিনি নিশ্চিত জানেন মিলি আধা ঘণ্টার মধ্যে আসবে। এবং আসার আগে ঢাকা শহরে যত পরিচিত লোকজন আছে সবাইকে টেলিফোন করবে। টেলিফোনের ভাষাটা হবে এরকম–সর্বনাশ হয়ে গেছে –টগরের শরীর খুব খারাপ। এখন তখন অবস্থা। হাসপাতালো নিয়ে গেছে। এক্ষুণি আসুন।
অপলা বলল, মিলি আপ আসছে নাকি?
হ্যাঁ আসছে। মনে হচ্ছে বিরাট একটা দল নিয়ে আসবে। ও ঝামেলা ছাড়া কিছু করতে পারে না।
অপলা অল্প হাসল। ওসমান সাহেব বললেন, ক্ষিধে পেয়েছে, রাতের খাওয়া হয়নি। তোমরা কিছু খেয়েছ?
না।
বলুন।
যা ভাবা গেছে, টেলিফোন এনগেজড। মিলি নিশ্চিয়ই পাগলের মত চারিদিকে টেলিফোন করছে। ওসমান সাহেব বেশ শব্দ করেই হাসলেন। অপলা খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, আপনাকে একটা কথা বলব দুলাভাই?
বল।
আগে কথা দিন রাগ করতে পারবেন না।
না। রাগ করব না।
এই যে টগর এরকম অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে এটা আপনাকে এফেক্ট করেনি। ঠিক না?
ওসমান সাহেব জবাব দিলেন না। অপলা বলল আপনি কী আমার ওপর রাগ করেছেন?
না, রাগ করিনি।
আমার ধারণা ছিল কবি-সাহিত্যিকদের অনুভুতি অনেক তীক্ষ্ণ। ধারণাটা বোধ হয়। সত্যি না।
একজনকে দিয়েই সবার বিচার করা ঠিক?
অপলা চুপ করে রইল। সে একটু লজ্জিত বোধ করেছে। মজিদ সাহেবকে সিগারেট হাতে হাসতে হাসতে আসতে দেখা গেল।
স্যার, আমার স্ত্রী আপনাকে চিনেছে। আপনার তিনটা বই সে পড়ছে। এর মধ্যে দু’টা খুব ভাল লেগেছে। নাম বলেছিল। এখন মনে নাই।
ওসমান সাহেব জবাব দিলেন না। পানির তৃষ্ণা অনেক বেড়েছে। কোথায় পানি পাওয়া যাবে কে জানে।
রাত দুটার দিকে রানু এসে বলল, টগরের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ডাক্তার বলেছে অক্সিজেন দিতে হবে। রানু কাঁপছে থরথর করে। ওসমান এগিযে এসে তার হাত ধরলেন।
রানু কাঁদতে শুরু করল। এত ভয় পেয়েছে সে? ওসমান সাহেব বিব্রত বোধ করতে লাগলেন। আশপাশে কেউ নেই। বারান্দার শেষ প্ৰান্তে মজিদ সাহেব দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি আড়ালে সরে গেলেন। এই ছোট্ট ভদ্রতাটি ওসমান সাহেবের বড় ভাল লাগল।
রানুর হাত থারথার করে কাঁপছে। ওসমান সাহেব মৃদু স্বরে বললেন, কোন ভয় নেই রানু। এরকম অভয়বাণী দেয়ার যোগ্যতা কী তার আছে? তিনি ডাক্তার নন। মহাপুরুষও নন। রানু যেমন ভয় পেয়েছে, তিনিও পেয়েছেন। তবু অভয় দেয়ার দায়িত্বটি তিনি নিলেন কেন? পুরুষ হিসেবে এই দায়িত্ব কী আপনাতেই এসেছে তার কাছে?
রানু চল টগরের কাছে যাই। মিলিরা এসে পড়বে।
টগর জেগে আছে কী ঘুমিয়ে আছে তা টের পাওয়া যাচ্ছে না। অক্সিজেনের নল তার নাকে স্কচ টেপ দিয়ে আটকানো। অল্প বয়সী ডাক্তারটি তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। টগরের যে খুব কষ্ট হচ্ছে তা মনে হল না। সে বেশ স্বাভাবিকভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।