ওসমান সাহেবের পানির তৃষ্ণা হচ্ছিল। এখানে পানি কোথায় পাওয়া যাবে কে জানে। অপল বিরক্ত স্বরে বলল, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? যান, আপা একা আছে।
তুমি এখানে বসে আছ কেন?
এমনি আমার ভাল লাগছে না।
অপলা অন্য দিকে মুখ ফেরাল। ঝগড়া-টগড়া কিছু হয়েছে। মেয়েরা অদ্ভুত অদ্ভুত সময়ে ঝগড়া করতে পারে।
এই ক্লিনিক বিত্তবানদের জন্যে। বেশ বড় বড় রুম। জানালায় সুন্দর পর্দা। প্রশস্ত বেডে ফোমের তোষক। ওসমান সাহেব দেখলেন টগর কোত হয়ে ঘুমুচ্ছে। তার মুখ অস্বাভাবিক বিবর্ণ। গায়ে ধবধবে সাদা একটা চাদর। সাদা চাদর সব সময় মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দেয। ওসমান সাহেব মনে মনে ঠিক করলেন রানুকে বলবেন চাদরটা বদলে দিতে।
রানু খুব ভয় পেয়েছে। সে বসে আছে টগরের মাথার পাশে। কিছুক্ষণ পরপরই টগরকে ছুঁয়ে দেখছে।
টগর বেঁচে আছে। এ ব্যাপারে সে যেন নিশ্চিত হতে চান। রানুর চোখের নিচে কালি পড়েছে। সে কাঁপছে অল্প অল্প। এতটা ভয় পাওয়ার মত সত্যি কী কিছু হয়েছে? টগর তো ঘুমুচ্ছে বেশ স্বাভাবিকভাবে। ওর ঘুমন্ত মুখে তেমন কোন যন্ত্রণা ছাপ নেই। কোথায় যেন পড়েছিলেন, শিশুদের মুখে শারীরিক কোন কষ্টের ছাপ পড়ে না। ওসমান সাহেব মৃদু স্বরে বললেন, ও কেমন আছে?
ভাল। ঘণ্টাখানেক আগে ঘুমিয়েছে।
গায়ে জ্বর আছে?
আছে।
তিনি টগরের কপালে হাত রাখতেই সে কেঁপে উঠল। যেন সে বুঝতে পারছে অপরিচিত কারোর স্পর্শ। এ হাত মায়ের হাত নয়।
বেশ জ্বর তো গায়ে।
হ্যাঁ। বারটার সময় আরেক ডোজ ওষুধ পড়বে।
ওসমান সাহেব ইতস্তত করে বললেন–ক্লিনিকের কাউকে বল সাদা চাদর বদলে একটা রঙিন চাদর দিতে।
কেন?
এমনি বলছি। কারণ নেই।
রানু কঁপা গলায় বলল— কারণ নিশ্চয়ই কিছু আছে। তুমি বল।
সাদা চাদর মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দেয়।
রানু কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে টগরের গায়ের চাদর তুলে ফেলল। ওসমান সাহেব শান্ত স্বরে বললেন–এত ভয় পাচ্ছি কেন রানু? ভয়ের কিছু নেই।
তুমি বুঝলে কী করে ভয়ের কিছু নেই?
তিনি এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারলেন না। কিন্তু রানু তাকিয়ে আছে আগ্রহ নিয়ে। সে একটা জবাব চায়।
বল কী করে বুঝলে ভয়ের কিছু নেই?
আমার মন বলছে। দেখবে ও সকালের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠবে।
রানু বলল, বারটা বাজতে কত দেরি বল তো?
পনেরো মিনিট।
হল ঘরে একজন নার্স আছে তাকে খবর দাও। বারটার সময় ওষুধ দিতে হবে। আর শোন, তুমি কী আত্মীয়-স্বজন সবাইকে খবর দিয়েছ?
না। কাউকে কিছু বলিনি।
সবাইকে বল।
দরকার আছে কোনো?
আছে। নয়ত পরে সবাই রাগ করবে।
কথাটা মিথ্যা নয়। এদেশে অসুখ-বিসুখ সামাজিক ব্যাপার। যথা সময়ে সবাইকে জানাতে হবে। কেউ যেন বাদ না পড়ে। কাউকে খবর না দেযাব মানে হচ্ছে তাকে দাম দেযা হয়নি। তুচ্ছ করা হয়েছে।
ওসমান সাহেব ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। নার্সকে দেখা গেল ট্রেতে করে ওষুধপত্র সাজিয়ে আনছে। ক্লিনিকটি মনে হচ্ছে ভালই। ঘড়ি ধরে সব হচ্ছে। বারটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি আছে এখনো।
নার্স মেয়েটি মধ্য বয়সী। গায়ের রঙ শ্যামলা। কিন্তু ধবধবে সাদা শাড়ির জন্যে তাকে কালো দেখাচ্ছে। ভালই লাগছে। মেয়েটির মধ্যে মা মা ভাব আছে।
ওসমান সাহেব হাসিমুখে তাকালেন। মেয়েটি বিরক্ত গলায় বলল–এত মানুষ কেন এখানে? শুধু একজন থাকবেন। ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করেন। ক্লিনিকের নিযম-কানুন মানতে হবে তো।
মেয়েটির গলার স্বর পুরুষালি। কথা বলার ভঙ্গিটিও বাজে। ওসমান সাহেব ওয়েটিং রুমে চলে এলেন।
অপলা বেঁটে মত একটি লোকের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে। লোকটির হাতে একটা জুলন্ত সিগারেট। সে হাত মুঠো করে অদ্ভুত ভঙ্গিতে সিগারেট টানছে। ওসমান সাহেব এগিয়ে আসতেই সে হাসি মুখে বলল স্নামালিকুম স্যার, আবদুল মজিদ। আমার নাম। পিডিপিতে কাজ করি।
ভদ্রলোকের গলার স্বর এমন যেন দীর্ঘদিনের পরিচয় তাদের। ওসমান সাহেব অস্পষ্ট ভাবে হাসলেন।
আপনার কথা শুনলাম স্যার উনার কাছে। বিখ্যাত সাহিত্যিক। আপনাদের সাথে দেখা হওয়া ভাগ্যের কথা। সিগারেট নেন স্যার।
ওসমান সাহেব সিগারেট নিলেন। মজিদ দামী একটা লাইটার বিদ্যুৎগতিতে বের করল। হাসি মুখে বলল–আপনার নাম শুনেছি।
লেখা পড়ি নাই। আউট বই পড়ার আমার অভ্যাস নাই। আমি খুবই লজ্জিত।
লজ্জিত হবার কিছু নাই। পড়ার অভ্যাস অনেকের নাই। অনেকে সময়ও পায় না। আমার স্ত্রী অবশ্যি খুব পড়ে। রাত-দিন গল্পের বই নিয়ে আছে। আমাকে রাতে পড়ে শুনাতে চায়। যা মুসিবন্ত। সারাদিন পরিশ্রম করে রাতে একটু ঘুমোব। তা না গল্প শোন। অন্য মানুষের জীবনের বানানো গল্প শুনে কোন লাভ আছে স্যার বলেন?
না। লাভ আর কী।
এই তো আপনি স্বীকার করলেন। অনেস্টলি এডমিট করলেন। নিজে সাহিত্যিক হয়েও করলেন। আপনি স্যার গ্রেটম্যান।
অপলা হাসছে মুখ টিপে। ওসমান সাহেব অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। মজিদ ক্রমাগত কথা বলে যেতে লাগল–তার স্ত্রীর ব্যথা কীভাবে উঠিল, কত ঝামেলা করে আসতে হল এখানে। এসে দেখা গেল। ফলস পেইন। আসার সময় আত্মীয়-স্বজন কাউকেই খবর দেয়া হয়নি। এখান থেকে টেলিফোন করারও উপায় নেই। কারণ তার সব কিছু মনে থাকে। কিন্তু টেলিফোন নাম্বার মনে থাকে না। একটা কালো ডাইরিতে সব নাম্বার লেখা আছে কিন্তু তাড়াহুড়ার জন্যে সে ডাইরিটাই আনা হয়নি। অপলা বললো–আপনার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করুন। তাঁর নিশ্চয়ই মনে আছে। মেয়েদের এসব জিনিস খুব মনে থাকে।