তোমার ধারণা বমি করব?
একমাত্র মাতালরাই প্রতিটি কথা দুবার করে বলে। তুমি দযা করে বাথরুমে যাও।
আমি আরো দশ পেগ খেতে পারি, তা জানো?
খেতে পাবলে তো ভালই।
মনিকা তীক্ষা কণ্ঠে হেসে উঠল। এবং আশ্চৰ্য, নবীকে কিছুক্ষণেব মধ্যে সত্যি সত্যি বাথরুমে ছুটে যেতে হল। মনিকা মাতাল চেনে।
ওসমান সাহেব নবীর দিকে তাকালেন। নবী সে চাউনি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে মনিকাকে বলল, ক্ষিধে লেগেছে। কিছু খাব?
কিছুক্ষণের মধ্যেই টেবিলে ডিনার দেযা হবে। এখন একটু ভাল লাগছে?
নবী তার জবাব না দিয়ে ওসমান সাহেবেব পাশে গম্ভীর মুখে বসল। ওসমান সাহেব বললেন কেমন আছেন?
ভাল।
নাটকের কাজ কেমন এগুচ্ছে?
ধরিনি এখনো। আমি তো আপনার মত না যে এক সপ্তাহে দু’টা উপন্যাস নামিয়ে দেব। আমি কম লিখিব; কিন্তু যা লিখব ভাল লিখব।
মনিকা হালকা গলায় বলল তোমার ধারণা উনি ভাল লিখছেন না?
পাঠযোগ্য লেখা মানেই ভাল লেখা না। ডিটেকটিভ উপন্যাসও তরতর করে পড়া যায়।
তুমি এটা বলছ ঈর্ষা থেকে।
ঈর্ষা? কিসের ঈর্ষা? আমি ঈর্ষা করি মানিক বাবুকে, ওসমান সাহেবকে ঈর্ষা করব কেন? তা ছাড়া ঈর্ষা একটি মেয়েলি ব্যাপার। পুরুষ মানুষদের ঈর্ষা থাকে না।
ওসমান সাহেব ঘড়ি দেখে বললেন আমি আজ উঠি। নবীর মুখ গম্ভীর। মনিকা খানিকটা অপ্রস্তুত বোধ করছে। সে কিছু বলল না। নবী বলল, আমিও উঠব। মনিকা বলল, ক্ষিধে লেগেছে বলেছিলে।
এখন ক্ষিধে নাই।
ভাত খেয়ে বিশ্রাম নাও। ড্রাইভার তোমাকে পৌঁছে দেবে। তুমি নিজে নিজে ড্রাইভ করে যেতে পারবে না।
আমি ঠিকই পারব। তুমি সব ব্যাপারে আমাকে আন্ডারএস্টিমেট কর।
সব ব্যাপারে করি না। কিছু কিছু ব্যাপারে করি।
নবীর মুখ আরও গভীর হল। সে ওসমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলল–আমার ওপর যদি ভরসা থাকে তাহলে আমি আপনাকে একটা লিফট দিতে পারি। মাতালের গাড়িতে চড়বেন?
ওসমান সাহেব হাসলেন। তিনি রাজি আছেন।
নেশাগ্রস্ত ড্রাইভারদের প্রবণতা হচ্ছে স্পিড বাড়ানো। সবাইকে দেখানো যে ঠিক আছে। গাড়ি চালানোর কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু নবীর গাড়ি চলছে খুব ধীরে। সে বড় রাস্তায় না উঠা পর্যন্ত কোনো কথা বলল না। তাকে দেখে মনে হল সে খুবই চিন্তিত। ওসমান সাহেব বসে আছেন। চুপচাপ। একবার শুধু বললেন, আমাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার দরকার নেই। রাস্তার মোড়ে নামিয়ে দিলেই চলবে। নবী তার জবাব না দিয়ে হঠাৎ গাড়ির গতি অনেকখানি বাড়িয়ে দিল।
নবীকে তিনি পছন্দ করেন? এই প্রশ্নটি অনেকবার নিজেকে করেছেন। কখনো ঠিক জবাব পাননি। আজও পেলেন না। ওসমান সাহেব দুপুর উপন্যাসটি পড়েছেন। এটি একটি প্রথম শ্রেণীর রচনা। এক মসজিদের পেশ ইমাম–জেনাব আলী, এক দুপুরে ঠিক করল একটি খুন করবে। সে সিন্দুকের ভেতর থেকে গরু কোরবানীর প্রকাণ্ড ছুরিটি বের করে ধার দিতে বসল। কাকে সে খুন করবে। উপন্যাসের কোথাও তা বলা হল না।
নানান চরিত্রকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হল একে একে এবং মনে হল এদের সবাইকে খুন করা যেতে পারে। যে লোক এমন একটি জটিল বিষয়কে এত চমৎকার ভঙ্গিতে উপস্থিত করতে পারে তাকে পছন্দ করতেই হয়। ওসমান সাহেব হঠাৎ করে বললেন–নবী সাহেব, আপনি কী আমার কোনো লেখা পড়েছেন?
সেন্টিমেন্টাল লেখা আমি পড়ি না। আপনার একটা লেখা পড়তে চেষ্টা করেছিলাম, মেয়েলি জিনিসে এমন ঠাসা যে গা ঘিন ঘিন করে। মেয়েদের গায়ের গন্ধ পাওয়া যায়।
মেয়েদের গায়ের গন্ধ খুব কী খারাপ?
না খারাপ না ভাল। কিন্তু উপন্যাসে উঠে এলেই খারাপ। আধুনিক কালের সাহিত্যে সেন্টিমেন্টের কোনো ব্যবহার থাকা উচিত নয়। একালের লেখা হবে জার্নালিস্টিক।
ওসমান সাহেব তর্কে গেলেন না। নবী বলল, আপনি রাগ করলেন নাকি?
না।
আমি যা বললাম তা কি স্বীকার করেন?
পুরোপুরি না করলেও কিছু করি।
আপনার জীবদ্দশাতেই যখন আপনার লেখা কেউ পড়তে চাইবে না, তখন পুরোপুরি স্বীকার করবেন।
নবী গাড়ি বাড়ির সামনে এনে রাখল। ওসমান সাহেব বললেন–নামবেন? ক্ষিধের কথা বলেছিলেন। আমার সঙ্গে খেতে পারেন। নবী থেমে থেমে বলল–আমি আপনার এখানে খাব না! আমি এখন আবার মনিকার ওখানে যাব।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। আমি বের হয়ে এসেছি আপনাকে বের করে আনার জন্যে।
ওসমান সাহেব তাকিয়ে রইলেন। নবী বলল–ওকে আজ আমি একটা কথা বলব। সুস্থ অবস্থায় কথাটা বলার চেষ্টা করেছি। বলতে পারিনি। সে জন্যেই পাঁচ পেগ হুঁইস্কি খেয়ে গিয়েছিলাম। বুঝতে পারছেন?
পারছি।
জানতে চান?
না, আমি জানতে চাই না।
জানতে না চাইলেও আমি আপনাকে শুনাতে চাই। লিসন কেয়ারফুলি। আমি মনিকাকে বিয়ে করতে চাই। এই কথাটি আজ তাকে বলব। তার হ্যাসবেন্ড থাকুক না থাকুক তাতে কিছু আসে যায় না। বুঝতে পারছেন?
বুঝতে চেষ্টা করছি।
আপনার ধারণা মদের ঝোঁকে এসব বলছি?
বলতেও পারেন। অনেকে বলে। এ নিয়ে আমি ভাবছি না।
নবী হিসহিস করে বলল–
আমি ষাট মাইল স্পিডে গাড়ি চালিয়ে যাব এবং মরব না। এতেই প্রমাণ হবে। আমি মাতাল নই। কি বলেন?
সে একসিলেটারে চাপ দিল। গাড়ি লাফিয়ে উঠল।
মিলি চুপি চুপি
মিলি চুপি চুপি তার স্টিলের আলমারি খুলল। তার ভাবভঙ্গি অনেকটা চোরের মত। দরজা ভেজিয়ে দিয়েছে। সব কটা পর্দা টেনেছে এবং এমনভাবে আলমারির সামনে আছে যাতে চট করে আড়াল করা যায়। তবু তার হাত কাঁপিছে। সে ঘন ঘন তাকাচ্ছে ভেজানো দরজার দিকে।