দ্বিতীয়বারেও তাই। এরপর থেকে আর চাইতে হয় না। পানি আসে। তিনি ঘড়ি দেখলেন সাড়ে নটা। আর মনে হচ্ছিল রাত অনেক। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। কোন কোন বাড়িতে পা দেয়া মাত্র মনে হয় ঘড়ির কাটা অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
মনিকা আসতে খুব দেরি করছে। তিনি বসে আছেন একা একা। এটি নতুন কোনো অভিজ্ঞতা নয়। মনিকার ব্যবহারে কোথায় যেন একটি অবহেলার ভাব আছে। প্রথম যখন এ বাড়িতে এলেন সেদিনই ব্যাপারটা চোখে পড়েছিল। যদিও সেদিন মনিকা এগিয়ে এসে সবাইকে হতচকিত করে পা ছুঁয়ে সালাম করল। নবী ছিল সঙ্গে। সে অবাক হয়ে বলল, একি কাণ্ড, সে কী রবি ঠাকুর নাকি? আমি তো জানি একমাত্র রবি ঠাকুরকেই লোকজন পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে। মনিকা বলেছিল, আমি স্কুলে পড়ার সময় ভেবে রেখেছিলাম। যদি কোনোদিন তাঁর সঙ্গে দেখা হয়। আমি সালাম করব। ওসমান সাহেব অত্যন্ত বিব্রত বোধ করতে লাগলেন। মনিকা সহজ স্বরে বলল, ক্লাস টেনে যখন পড়ি ঠিক করলাম। যদি উনি অবিবাহিত হন তাহলে তাকে গিয়ে বলব।–আমাকে বিয়ে করুন। নবী ঘর ফাটিয়ে হাসতে লাগল। ওসমান সাহেবের মনে হল হাসি স্বতঃস্ফূর্ত নয়। কষ্ট করে হাসা। নবীকে তিনি কখনো এভাবে হাসতে দেখেননি।
সে রাতে মনিকার সঙ্গে গল্প উপন্যাস নিয়ে কোনোই আলাপ হয়নি। মনিকার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল তার সমস্ত উৎসাহ মিইয়ে গেছে। সে পাকা আমের আচার বানানোর কী একটি পদ্ধতি নিয়ে গল্প করতে শুরু করল। এবং এক সময় উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমার প্রচণ্ড মাথাব্যথা হচ্ছে কিছু মনে করবেন না, আমি কিছুক্ষণ শুয়ে থাকব। ওসমান সাহেব অপমানিত বোধ করেছিলেন। তা সত্ত্বেও আবার একদিন এলেন নবীর সঙ্গে। সেদিনই মনিকার এ রকম আলগা আলগা ভাব। তার পরেও তিনি এলেন। কেন এলেন? কেন বারবার আসেন?
ওসমান সাহেব দ্বিতীয় সিগারেটটি ধারাবারও অনেক্ষণ পর মনিকা এল অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম? কাজের মেয়েটি চুল টেনে দিচ্ছিল, আরাম লাগছিল খুব। তোমায় পানি দিয়ে গেছে?
হ্যাঁ।
আরও লাগবে?
না, লাগবে না। নবী কোথায়?
গেস্ট রুমে ঘুমুচ্ছে। বমি-টমি করে বিশ্ৰী কাণ্ড। যে জিনিস সহ্য হয় না। সে জিনিস কেন খায়?
মনিকা বিরক্তিতে ভ্রূ কুঁচকাল। ওসমান সাহেব বললেন, তোমার হ্যাসবেন্ডের কোন খবর পেয়েছে?
না।
তিনি আছেন কেমন?
আগের মতই আছে। লাংসটলারেন্স, ই সি জি সব কিছুই হয়েছে। শরীরে কোনো অসুখ নেই। ডাক্তাররা বলছেন সাইকে সিমেটিক। মনের রোগ। কিন্তু সে সেটা বিশ্বাস করছে না। আরও বড় ডাক্তার দেখাতে চায়।
তাই নাকি?
হ্যাঁ মানসিক রোগীদের এই প্রবলেম। তারা কিছুতেই স্বীকার করতে চায় না রোগটা মনে, শরীরে নয়। তুমি চা খাবে?
না।
খাও এক কাপ। সিলোনিজ টি। খুব চমৎকার ফ্লেভার।
তিনি হ্যাঁ না কিছুই বললেন না। মনিকা কাজের মেয়েটিকে চায়ের কথা বলে তার সামনে এসে বসল। তার বসে থাকার ভঙ্গিতে কোন আড়ষ্টতা নেই। সে কোনো কথা বলছে না। কথা না বলে কোনো মেয়ে চুপচাপ বসে থাকলেও সমস্ত পরিবেশ আড়ষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু মনিকার বেলায় হয় না। কাজের মেয়েটি বলল–
উনার ঘুম ভাঙছে। আপনারে ডাকে। মনিকা কঠিন স্বরে বলল, তাকে এ ঘরে আসতে বল। বল তার বন্ধু এসেছে–ওসমান সাহেব।
নবী লম্বায় প্রায় ছফুট। গায়ের রঙ শ্যামলা। মেয়েলী ধরনের মুখ। চেহারায় কাঠিন্য আনবার জন্যে সে নানান সময় নানান কায়দা-কানুন করেছে। একবার জুলফি রেখেছে, একবার গোঁফ রেখেছে। কিছুদিন ফ্রেঞ্চকাট দাঁড়িও ছিল। লাভ হয়নি। কোনো এক বিচিত্র কারণে তার চেহারা থেকে ছেলেমানুষি দূর হয়নি।
যৌবনে দুর্দান্ত কিছু কবিতা লিখেছিলেন। হঠাৎ এক রাতে ঠিক করল কবিতা মেয়েদের ভাষা, কবিতায় কাঠিন্য নেই। প্রতীক, উপমা এইসব ছেলেমানুষি ব্যাপার। কাজেই সে চলে এল গদ্যে। লিখল দুপুর নামের উপমা ও প্রতীক বিবর্জিত উপন্যাস। প্রচুর লেখালেখি হল দুপুর নিয়ে। সমালোচকদের কেউ কেউ উল্লেসিত হলেন। কেউ কেউ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কোন বিদেশী ঔপন্যাসিকের ছাপ পড়েছে সেটা বের করবার জন্যে। কবিখ্যাতি তেমন না জুটলেও কথা-শিল্পীর স্বীকৃতি পাওয়া গেল। পুরোপুরি সাহিত্যে নিবেদিত না হলে কিছু লেখা যাবে না। এই ভেবে নবী চাকরি ছেড়ে দিল। পরবর্তী তিন বছর একটি লাইনও লিখল না। ইদানীং সে বলছে নাটক হচ্ছে সাহিত্যের সবচেয়ে পরিশীলিত রূপ। যে কোন এক শুভদিনে নাটক লেখা শুরু হবে এই ধরনের কথা শোনা যাচ্ছে গত ছ’মাস ধরে। এখনও কিছু লেখা হয়নি। শুভ দিন এখনো আসেনি। নবী ঘরে ঢুকল অপ্রসন্ন মুখে, মনিকার আজকের ব্যবহারে সে খুবই বিরক্ত হয়েছে। মনিকা বলেছিল–তুমি হুঁট করে ভিতরের ঘরে ঢুকবে না। এটা ভাল দেখায় না। এ কেমন কথা মনিকা তার ফুফাতো বোন এ-বাড়িতে সে আসছে ছেলেবেলা থেকে। মনিকার স্বামী তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। নবী অবাক হয়ে বলল, তুমি চাও না। আমি এ বাড়িতে আসি?
আসতে ইচ্ছা হলে আসবে। তবে হুঁট করে শোবার ঘরে ঢুকবে না। এবং মাতাল অবস্থায় আসবে না।
নবী অবাক হয়ে বলল। মাতাল বলছি কাকে? মাতাল কাকে বলে জানো?
মনিকা ঠাণ্ডা, গলায় বলল, মাতালের ডেফিনেশন নিয়ে তোমার সঙ্গে তর্ক করতে চাই না। তবে মাতাল আমার চেয়ে ভাল কেউ চেনে না। তোমার চাউনি দেখেই বুঝতে পারছি তুমি এক্ষুণি বমি করবে।
বমি করব?
হ্যাঁ।