উনি বুড়ো মানুষ। তুমি নিজেও জানো তার মাথা পুরোপুরি ঠিক না। তা ছাড়া যা ঘটেছে আমাকে বাদ দিয়েই ঘটেছে। মিলি প্রচুর মিথ্যা কথা বলে। তুমি তো মিলির স্বভাবও জানো। জানো না?
না। আমি তোমাদের কারোরই স্বভাব জানি না। তোমার নিজের স্বভাব বুঝতে আমার ছবছর লেগেছে।
বুঝতে পারলে কিছু?
হ্যাঁ, তোমারটা বুঝেছি।
ভাল। বুঝতে পারাই উচিত। তুমি বুদ্ধিমতি মেয়ে।
ওসমান সাহেব উঠে দাঁড়ালেন আজ যাই। রানু তীক্ষু কণ্ঠে বলল খুব তাড়া মনে হয, কোথায় যাচ্ছ, মনিকার কাছে?
হ্যাঁ, ওর কাছে যাব একবার।
সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হবে? আজকেব। আলোচনার বিষযবস্তু কী? সতীনাথ ভাদুড়ি না মানিক বাবু?
তিনি ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আজ তুমি নানা কারণে উত্তেজিত। কাজেই বেশিক্ষণ থাকতে চাই না।
মনিকা কখনো উত্তেজিত হয় না, তাই না?
হবে না কেন, সেও হয়। আমরা সবাই নানা কারণে উত্তেজিত হই।
ওসমান সাহেব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন রানু তার সঙ্গে সিঁড়ি পর্যন্ত এসেছে। তিনি শান্ত স্বরে বললেন, টগারকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও। রানু তার জবাব দিল না।
টগরের ঘুম ভাঙািল ছাঁটার দিকে। ভাল মানুষের মত কাঁপে করে মালটোভা খেল। তবে কিছুক্ষণ পরই ঘর ভাসিয়ে বমি করল। অপলা বলল খারাপ লাগছে নাকি টগর?
না!
চল আমরা ডাক্তারের কাছে যাব। আয় শার্টটা বদলে দেই। তার আগে চল মুখ ধুইযে দি।
টগর বাধ্য ছেলের মত অপলার সঙ্গে সঙ্গে গেল। বাথরুমে ঢুকেই গলাব স্বর নিচু করে বলল, আজ কী বুধবার খালামণি?
হ্যাঁ, কেন?
টগর, আর কোন কথা না বলে হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে আয়নায় তার দাঁত দেখতে লাগল। উপবেব পাটির একটি দাঁত নেই। কেমন অচেনা দেখাচ্ছে তাকে। আঁপিলা বলল, দাঁত তোলার সময ব্যথা লেগেছিল? টগর তার জবাব না দিয়ে দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করল আজ কি বার খালামণি? বুধবার?
মনিকার ওখানে যাবার কোন ইচ্ছা ওসমান সাহেবের ছিল না। তবু ওদিকেই রওনা হলেন। ঘরে ফিরে কিছু করবার নেই। ফিরতেও ইচ্ছা করছে না।
মনিকাদের বাড়ির সামনে নবীর লাল গাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে। কোথায় যেন পড়েছিলেন অন্ধকার বস্তুর কোন রঙ থাকে না। সব হয়ে যায় ধূসর বর্ণ। কিন্তু তিনি অন্ধকারেও গাড়ির লাল রঙ দেখতে পেলেন। কিংবা হয়ত এই গাঢ় লাল রঙ তার স্মৃতিতে ছিল। এখন যা দেখছেন তার কিছুটা আসছে স্মৃতি থেকে, কিছুটা সত্যি সত্যি দেখছেন।
গাড়ি গেটের বাইরে কেন? ওসমান সাহেব একধরনের অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। চিত্রটি ঠিক মিলছে না। নবী তার গাড়ি গেটের বাইরে রেখে মনিকার সঙ্গে দেখা করতে আসবে না। এই জিনিস ওর চরিত্রে নেই। বুড়ো দারোয়ান উঠে দাঁড়িয়ে বিনীত ভঙ্গিতে সালাম করল। ওসমান সাহেব বললেন, রহমত ভাল আছ? রহমতের মাথা অনেকখানি নিচু হয়ে গেল।
মেম সাহেব আছেন?
জি আছেন।
তোমার শরীর এখন সেরেছে তো?
জি স্যার।
ব্যথা হয় না আর?
আগের মত হয় না।
রহমত তাঁর সঙ্গে হেঁটে বাড়ির সিঁড়ি পর্যন্ত এল। এই লোকটিও তাঁকে খুবই পছন্দ করে। কেন করে কে জানে। ওসমান সাহেব এসব ছোটখাটো ব্যাপার লক্ষ্য করেন। আজও লক্ষ্য করলেন রহমত এগিয়ে গিয়ে অসহিষ্ণুভাবে পর পর তিন বার কলিং বেল টিপল। তিনি ভাল জানেন ফেরার সময়ও সে হেঁটে হেঁটে তাঁর সঙ্গে বড় রাস্তা পর্যন্ত যাবে। কথাবার্তা বিশেষ কিছু বলবে না।
মানুষের ভালবাসা কখনো নিঃস্বাৰ্থ নয়। রহমতের ভালবাসা কী নিঃস্বাৰ্থ? তিনি কখনো এ ব্যাপারটি নিয়ে গভীরভাবে ভাবেননি। ভাবতে হবে।
মনিকা দরজা খুলে ছোট করে হাসল। যেন সে তার জন্যে অপেক্ষা করছিল। মনিকার গায়ে হালকা নীল রঙের সুতির শাড়ি। গলায় লাল একটা মাফলার। আবার ঠাণ্ডা লেগেছে বোধ হয়। মনিকার ঘন ঘন ঠাণ্ডা লাগে।
ভাল আছি মনিকা?
ভালই ছিলাম। ঘণ্টাখানেক আগে থেকে আর ভাল নেই। নবী এসেছে বড্ড পাগলামী করছে। তিনি কিছুই বললেন না। মনিকা বলল আজি আমি ওকে স্ট্রেইট বলেছি আমার বাড়িতে আর আসবে না।
সে তো আগেও বলেছে।
আজ যেভাবে বলেছি সেভাবে আগে কখনো বলিনি। আজ সত্যি সত্যি বিরক্ত হয়েছি।
ওসমান সাহেব বসার ঘরে কাউকে দেখলেন না। একবার ভাবলেন জিজ্ঞেস করবেন নবী কোথায়? তাও করলেন না। মনিকা গভীর গলায় বলল তুমি খানিকক্ষণ একা একা বস। আমি চুল বেঁধে আসি।
তিনি প্রায় দুমাস পর এলেন। মনিকা একবারও জিজ্ঞেস করল না, এতদিন আসা হয়নি কেন? মনিকার কিছু বিচিত্র ব্যাপার আছে।
এই বসার ঘরটিতে ওসমান সাহেব ঠিক সহজ বোধ করেন না। সব কিছু বড় বেশি গোছানো। কাঁপেটের রঙ টকটকে লাল। এই রঙ রক্তের কথা মনে করিযে দেয়। রক্তের ওপর পা রাখতে তার ভাল লাগে না।
ওসমান সাহেব সিগারেট ধরাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজের মেয়েটি ট্রেতে করে এক গ্লাস পানি রেখে গেল। রুপোর গ্লাস। খুবই ঠাণ্ডা পানি। গ্লাসের চারদিকে বিন্দু বিন্দু পানি জমেছে যা দেখা মাত্র তৃষ্ণা পায়। ওসমান সাহেব তৃষ্ণার্তের মত পানি খেলেন। কাজের মেয়েটি বলল, আর এক গ্ৰাস পানি আনি?
না, আর লাগবে না।
চা আনব?
চা আনতে হবে না।
ওসমান সাহেব লক্ষ্য করলেন মেয়েটি হাসি চাপতে চেষ্টা করছে। তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। মেয়েটির মুখে হাসি দেখতে দেখতে মিলিয়ে গেল। শঙ্কার ছাপ পড়ল। সে গ্লাস নিয়ে দ্রুত সরে পড়ল।
প্রথম যেদিন এ বাড়িতে এসেছিলেন সেদিন ওসমান সাহেব সোফায় বসে পানি খেতে চেয়েছিলেন।