বিরাট সেক্রেটারিয়েট টেবিল। কিন্তু কোনো কাগজ বা ফাইলপত্র নেই। টেবিলের মাঝখানে ধবধবে সাদা একটা ফুলদানি ভর্তি ফুল। ঘরের এক কোণায ছোট্ট একটা আলনা, সেখানে টাওয়েল ঝুলছে। অফিস ঘরে আলনা কেন কে জানে।
আপনি কেমন আছেন বলুন।
আমি ভালই আছি।
চা কফি কোনটাই খাব না।
সিদ্দিক সাহেব সিগারেট ধরিয়ে চিন্তিত মুখে টানতে লাগলেন। এখানে সম্ভবত কিছু হবে না। রানুর ধারণা ছিল হবে। গত সপ্তাহের কথাবার্তা এরকমই ছিল। সিদ্দিক সাহেব হাসিমুখে বলেছিলেন–পোস্ট না থাকলেও অনেক সময় পোস্ট তৈরি করা হয। আপনি আগে মন ঠিক করুন। রানু বলেছিল আমার মন ঠিক করাই আছে।
বেশ তাহলে আগামী সপ্তাহে আসুন। দশটার আগে আসতে পারবেন?
পারব।
সেদিন সিদিক সাহেবের যে হাসি-খুশি ভাব ছিল আজ তা নেই। গম্ভীর মুখে সিগারেট টানছেন। যেন কোনো একটি অস্বস্তিকর কথা বলতে দ্বিধা করছেন।
সিদ্দিক সাহেব একটি মুখবন্ধ খাম এগিয়ে দিলেন। গম্ভীর গলায় বললেন। এখানে এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আছে। শর্তগুলি আপনার যদি পছন্দ হয়, তাহলে আপনি আগামী মাসের এক তারিখ থেকে জয়েন করতে পারেন।
কী পোস্ট, কী কাজ কিছুই তো বললেন না।
এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারে সব বলা আছে। তিন মাস আপনি থাকবেন ট্ৰেইনি হিসাবে। বিভিন্ন সেকশনে যাবেন এবং কাজ শিখবেন। তিন মাস পর আমরা যদি মনে করি আপনার ট্রেনিং ভাল হয়নি তাহলে সেটি এক্সটেন্ড করে। ছ’মাস করা হবে। ট্রেনিং পিরিয়ড আপনার ভাতা হবে মূল বেতনের অর্ধেক। অন্য কোন ফেসিলিটিও থাকবে না।
খামটা এখানে খোলা উচিত হবে কি না রানু বুঝতে পারছে না। সিদ্দিক সাহেব বললেন আপনি কী কিছু বলবেন?
জি না। থ্যাংক ইউ।
এখন নিশ্চিয়ই বাড়ি যাবেন?
জি।
একটু বসুন।
রানু বসে রইল। সিদ্দিক সাহেব বেল টিপে বেয়ারাকে ডেকে বললেন ড্রাইভার সাহেবকে বল ইনাকে বাসায় পৌঁছে দিতে।
জুনিয়র অফিসার্স গ্রেড। বেতন সব মিলিয়ে দুহাজার টাকার মত। এই চাকরি নেয়াটা কী ঠিক হবে? ড্রাইভার বলল,
আপা কোন দিকে যাব?
আমি যাব নিউ পল্টন। নিউমার্কেটে নামিয়ে দিলেই হবে। কিছু কেনাকাটা করব।
রানু কথাটা বলেই একটু অস্বস্তি বোধ করল। নিউমার্কেটে কেনাকাটা করব এটা বলার দরকার ছিল না। সাফাই গাইবার কোনো ব্যাপার নয়।
ওসমান সাহেব রানুর বসার ঘরে একা একা বসেছিলেন। রানুকে ঢুকতে দেখে তিনি তাকালেন। রানুর হাতে এক গাদা জিনিসপত্র। দুহাতে সেগুলি ঠিক সামলানোও যাচ্ছিল না। ওসমান সাহেব সহজ স্বরে বললেন, অনেক কিছু কিনলে দেখি। রানু কিছু বলল না। জিনিসপত্র নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
অপলা টগরের পাশে শুকনো মুখে বসে আছে। সে রানুকে দেখেই বলল-ওর তো বেশ জ্বর আপা। একশ দুইয়ের উপরে। তিন-চারবার বমি করেছে। রানু বলল–ও কখন এসেছে?
বেশিক্ষণ হয়নি। দশ-পনেরো মিনিট। আমি বলেছিলাম ভেতরে এসে বসতে। উনি আসেননি।
রানুটিগরের কপালে হাত দিয়ে উদ্বিগ্ন মুখে জ্বর দেখল। শুকনো মুখে বলল–থার্মোমিটারটা আবার দে তো দেখি।
অপলা বলল, চল ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। দুলাভাই আছেন তাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাব।
তাকে সঙ্গে করে নিতে হবে কেন?
অপলা চুপ করে গেল। থার্মোমিটার দেখল রানু বলল কত?
একশ এক। একটু কমেছে। জ্বর ছেড়ে যাবে বোধ হয়। ঘাম হচ্ছে।
রানু কিছু বলল না। অপলা বলল–তুমি বাইরের ঘরে গিয়ে বস। অনেকক্ষণ উনি একা বসে আছেন।
রানু মনে হল শুনতেই পেল না।
অপলা বলল–তুমি চা খাবে, চা দেব? পানি গরম আছে।
না, চা-টা কিছু খাব না।
রানু বসার ঘরে ঢুকল। ওসমান সাহেব বললেন, জ্বর কী খুব বেশি? বেশি হলে একজন ডাক্তার নিয়ে আসি। কাছেই আমার একজন চেনা ডাক্তার আছেন।
ডাক্তার আনতে হবে না। আমি নিয়ে যাব।
জ্বর কবে থেকে?
দু-তিন দিন থেকে।
আমাকে তো খবর দাওনি।
খবর দেওয়ার মত কিছু হয়নি। তাছাড়া আমার খবর দেবার লোক নেই। তুমি ভাল করেই জান।
তোমার খালার বাসায় টেলিফোন নাই?
আছে। তাদের টেলিফোন আমি আমার নিজের কাজের জন্য ব্যবহার করব কেন?
ওসমান সাহেব বিস্মিত হয়ে বলল–তোমার খালার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক ভাল না নাকি?
সম্পর্ক খারাপ হবে কেন?
অপলা চা নিয়ে ঢুকল, লজ্জিত মুখে বলল, চা ছাড়া আর কিছুই নেই। শুধু চা দিলাম।
আর কিছু লাগবে না।
রানু বলল–অপলা তুই ঘরে যা আমি একটু কথা বলছি। অপলা বিব্রত ভঙ্গিতে ঘরে গেল। ওসমান সাহেব তাকালেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। রানু বলল আমি একটি চাকরি পেয়েছি। কাজেই তুমি মাসে যে টাকাটা দিতে সেটা আর দিতে হবে না।
চাকরিটা কী?
সেটা দিয়ে তোমার তো কোন দরকার নেই। তোমার স্ত্রী হিসাবে আমি যদি নিচু ধরনের কাজ করতাম তাহলে হয়ত তোমার অহংকারে লাগত। এখন তো অহংকারে লাগার কোনো প্রশ্ন নেই।
তুমি ভুল করছি রানু আমি অহংকারী না।
বাজে কথা বলবে না।
তিনি চুপ করে গেলেন। রানু থমথমে গলায় বলল, কেন তুমি আমাকে তোমার বাবার কাছে এ রকম একটা কায়দা করে পাঠালে?
কী কায়দা?
মিলি এসে বলল উনি খুব অসুস্থ। মৃত্যুশয্যায়। আমাকে এবং টগরকে দেখতে চান। আমি ঠিক সেই দিনই গেলাম দেখা করতে। গিয়ে দেখি দিব্যি সুস্থ মানুষ। বাগানে ফুলগাছ লাগাচ্ছেন। আমার সঙ্গে এমন ভাবে কথা বলতে লাগলেন যেন আমাকে চেনেন না। এই প্রথম দেখলেন। টগর ফুল গাছে হাত দিয়েছিল বলে ধমক দিলেন। বিশ্ৰী গলায় ধমক।