টগর ঘুমের মধ্যেই নড়ে উঠল। রানু ডাকল এই টগর!
সে তার ছোট হাত দু’টি দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল। কেমন তাকাচ্ছে পিট পিট করে।
টগর, এই পাজী।
কী।
টগর মাথা নাড়ল। তার খারাপ লাগছে। কিন্তু মুখ হাসি হাসি। বলল দুধ খাবি?
বোতলে করে খাব।
এত বড় ছেলে বোতলে করে খাবি কি? মালটোভা দিয়ে বানিয়ে দেব। এক চুমুকে খেয়ে ফেলবি, ঠিক আছে?
টগর ঘাড় কাত করল, সে গ্লাসে করে দুধ খেতে রাজি আছে।
বেশি করে চিনি দিও।
দেব।
দুধ বানিয়ে এনে রানু দেখল টগর বালিশটা দুপায়ের ফাঁকে নিয়ে এসে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, জ্বর কি কমে আসছে? রানু অনেক্ষণ ছেলের পাশে বসে রইল।
রান্নাঘরে খুটখাট শব্দ হচ্ছে। আপলা জেগেছে নিশ্চয়ই। সেও খুব ভোরে ওঠে। হাত-মুখ ধুয়ে পড়তে বসে। মেডিকেলে টেস্ট দেবে। এ্যালাউ হবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। রোজ ঘুমুতে যায় দেড়টা-দুটোর দিকে। রানু রান্নাঘরে এসে দেখল অপলা চায়ের কেতলি বসিয়েছে। সে হাসি মুখে বলল–তুমি আজ এত ভোরে উঠলে যে? ব্যাপার কী?
ব্যাপার কিছু না।
টগরের জ্বর আছে এখনো?
কম, গা ঘামছে।
রাতে বেশ কয়েকবার কাদল। তখনি বুঝেছি শরীর খারাপ। ওকে আজ একবাবা ৬াওক্লাবের কাছে নিয়ে যাও।
রাতে কেঁদেছে নাকি?
হ্যাঁ, তুমি টের পাওনি?
না।
রানুর কিছুটা মন খারাপ হল। টগর, কেঁদোছে সে টেবও পায়নি। ও অবশ্যি কেঁদো-কেটে পাড়া মাথায় করবে না। নিজে নিজেই শান্ত হয়ে ঘুমুতে চেষ্টা করবে।
আপা চা খাবে?
খালি পেটে চা খাই না।
খালিপেটে হবে কেন। নোনতা বিস্কুট আছে, দেব?
দে।
অপলা চা ঢালতে ঢালতে বলল, তুমি চিন্তিত কেন? রাতে ভাল ঘুম হয়নি?
হয়েছে।
তাহলে? মুখ এমন শুকনো কেন?
টগরের আবার জ্বর আসল–এই জন্যই খারাপ লাগছে।
আপা তুমি একটা কাজ কর দুলাভাইকে খবর দাও। সে কযেকদিন ঘন ঘন আসুক। ছেলেকে নিয়ে ছোটাছুটি করুক, দেখবে জ্বর কমে যাবে।
রানু গম্ভীর হয়ে গেল। অপলা বলল কথা বলছি না কেন আপা? চুপ করে আছ কেন?
তুই সব সময় দুলাভাই দুলাভাই বলিস! সব জেনে-শুনেও কেন বলিস?
তাহলে কী বলব? টগরের বাবা? না ওসমান সাহেব?
রানু কিছু বলল না। নিঃশ্বাব্দে চায়ে চুমুক দিতে লাগল। অপলা বলল ঠিক আছে আর বলব না। কিন্তু তুমি তাকে আসতে বল। এক মাস ধরে আসছেন না।
আসতে না চাইলে আসবে না। ধরে নিয়ে আসতে হবে?
ঠিক তা-ও না। আপা। তুমিই আসতে নিষেধ করেছ।
নিষেধ করিনি। বলেছি, এত ঘন ঘন যেন না আসে। আমি জীবনটাকে বদলাতে চেষ্টা করছি। তুই কেন বুঝতে চেষ্টা করছিস না?
তোমার ধারণা উনি ঘন ঘন এলে জীবন বদলানো যাবে না?
এ নিয়ে তোর সঙ্গে কথা বলতে চাই না।
রানু উঠে পড়ল। টগরের ঘুম ভেঙেছে। সে গম্ভীর মুখে রওনা হয়েছে। বাথরুমের দিকে।
বয়সের তুলনায় সে কি একটু বেশি গম্ভীর? রানু ডাকল দেখি টগর এদিকে আয় তো, জ্বর আছে কি না দেখি। টগর গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এল।
এই তো জ্বর নেই। গুড বয়। যাও দাঁত মেজে আসা। নিজে নিজে মাজতে পারবে না?
পারব।
ভেরি গুড।
রানু শুনল–টগার, অপলার সঙ্গে কথা বলছে। ওর সঙ্গে তার বেশ ভাব। কথাবার্তা হচ্ছে বন্ধুর মত।
কেমন আছিস রে টগর?
ভাল।
তোর মার মত মুখটা এমন অন্ধকার করে আছিস কেন? কেমন করে হাসতে হয় মনে আছে?
আছে।
তাহলে বিরাট বড় একটা হাসি দে তো দেখি। বাহ বাহ চমৎকার। দেখি তোর নড়বগে দাঁতটার কী অবস্থা। কাছে আয়।
না।
না কেন?
তুমি ফেলে দেবে।
ফেলব না, হাত দিয়ে দেখব নড়ছে কি না। আয় কাছে আয়।
রানু, টগারের ছোট্ট একটি চীৎকার শুনল। তারপর আবার চুপ। অপলা বলছে–এইত ফেলে দিলাম, ব্যথা পেয়েছিস?
না।
তাহলে কাঁদছিস কেন? ব্যাটাছেলেদের এত কাঁদতে নেই, কাঁদবে মেয়েরা। তুই কী মেয়ে?
না।
যা, হাত-মুখ ধুয়ে আয়।
বাথরুমের কল দিয়ে পানি পড়ছে। টগর হাত-মুখ ধুচ্ছে নিশ্চয়ই। রানু অবাক হয়ে লক্ষ্য করল। দাঁত পড়ার মত একটা বড় ঘটনা সে তার মাকে বলতে এল না। যেন এটা বলার মত কিছু নয়। নাশতার টেবিলে খুব সহজভাবেই রানু জিজ্ঞেস করে–তোমার দাঁত পড়ে গেছে নাকি?
হ্যাঁ।
কই আমাকে তো কিছু বলনি। দেখি এখন তোমাকে কেমন দেখাচ্ছে। বাহ সুন্দর লাগছে তো।
টগর ছোট্ট করে হাসল। রানু বলল আজ আমি বাইরে যাব। তুমি অপলার সঙ্গে থাকতে পারবে না?
পারব।
বিকেলে তোমার বাবা আসবেন তোমাকে দেখতে।
আজি কী বুধবার?
রানুর বুকে ছোট একটা ধাক্কা লাগল। টগর কী মনে মনে তার বাবার জন্যে অপেক্ষা করে? নয় তো বুধবার তার মনে থাকার কথা নয়।
হ্যাঁ, আজ বুধবার। নাও এই রুটিটা খাও।
আদেকটা খাই?
ঠিক আছে খাও।
বাবা যখন আসবে তুমি তখন থাকবে না?
থাকব। আমি পাঁচটার মধ্যে আসব।
রানু খানিক্ষণ চুপ করে থেকে বলল–তুমি কী তোমার বাবার সঙ্গে ঐ বাড়িতে দু’একদিন থাকতে চাও?
টগর ঘাড় কাত করল। সে থাকতে চায়।
আমার জন্যে তোমার খারাপ লাগবে না?
টগর কিছু বলল না।
রাতে ঘুম ভাঙলেই কাঁদবে আম্মা কোথায়? আম্মা কোথায়? কাঁদবে না?
হ্যাঁ কাঁদব।
তাহলে যাবে কেন?
টগর জবাব দিল না! মায়ের দিকে সরাসরি তাকালও না।
রানু অনেকক্ষণ বসে থাকার পর তার ডাক পড়ল। সিদ্দিক সাহেব নিজে এসে ডেকে নিয়ে গেলেন। সহজ স্বরে বললেন–একটা বোর্ড মিটিং ছিল। তাই দেরি হল কিছু মনে করবেন না। আপনাকে চা-টা দিয়েছে তো?
হ্যাঁ দিয়েছে।
বসুন। এখানে। আরাম করে বসুন।
এই ঘরটি এয়ারকন্ডিশন্ড। হুঁম হুঁম একটা শব্দ হচ্ছে যন্ত্রটা হয়ত ভাল না। কিন্তু ঘর খুব সুন্দর করে সাজানো। অফিস মনে হয় না। মনে হয় অফিস নয় কারো ড্রয়িং রুম।