তিনি ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। পানির তৃষ্ণা হচ্ছে। হাতের কাছে কাচেব জগ কিন্তু পানি নেই। তিনি উঠে গিয়ে বাতি জ্বালালেন। গায়ে মুখে পানি ঢাললেন। রাত শেষ হয়ে এসেছে চারটা দশ বাজে। আবার ঘুমুতে যাবার কোন মানে হয না। চা খেতে ইচ্ছা হচ্ছে। বানাবে কে? বিয়ের পর পর ফ্লাস্ক ভর্তি করে চা বানিয়ে রাখত রানু। কোন ভাবে যদি লেখক স্বামীকে সাহায্য করা যায়। ডিকশনারি দেখে বানান ঠিক করা। লেখা কফি করে দেয়া। কত উৎসাহ। জীবনটাই অন্য রকম ছিল।
বিয়েব পরপর একবার এ রকম ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠলেন। ভযে অস্তিব হয়ে ডাকলেন–রানু রানু। রানুহকচকিয়ে গেল। ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী হয়েছে?
ভয় পেয়েছি। দুঃস্বপ্ন দেখেছি। দেখলাম একটা পাগল আমাকে তাড়া কবেছে।
বলতে বলতে তিনি শিউরে উঠলেন। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়তে লাগল। রানু অবাক হয়ে বলল এত ভয় পাওয়ার মত কি দেখলে, এর চেয়ে ভয়ঙ্কর স্বপ্ন তো আমি রোজই দেখি। ওসমান সাহেব নিচু গলায় বললেন না। এ রকম তুমি দেখ না। এটা একটা ভয়ানক স্বপ্ন। তোমাকে আমি বোঝাতে পারব না। সম্পূর্ণ অন্য রকম ব্যাপার।
রানু তার হাত ধরে অনেক্ষণ পাশে বসে রইল। তারপর চা বানিয়ে আনল।
ওসমান সাহেব শিশুর মত তাকে জড়িয়ে ধরে বাকি রাতটা জেগে কাটালেন। বানু নিজেও ঘুমাল না। একজন বয়স্ক মানুষ সামান্য একটা স্বপ্ন দেখে এতটা ভয় পেতে পাবে তা তার ধারণার বাইরে ছিল। সে নিচু স্বরে বলল তুমি কী প্রায়ই এ রকম দুঃস্বপ্ন দেখ?
প্রায়ই না মাঝে মাঝে দেখি।
সব সময় এ রকম ভয় পাও?
হ্যাঁ।
বেশ কিছু সময় চুপচাপ থেকে রানু বলল, তোমার এক গল্পের নায়ক এ রকম দুঃস্বপ্ন দেখত। ওসমান সাহেব কিছু বললেন না। রানু বলল বেচারা অবশ্যি শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে যায়।
তিনি রাগি গলায় বললেন ওর পাগল হওয়ার অন্য কারণ ছিল।
রাগ করছে কেন?
রাগ করছি না। লেখার সঙ্গে সবাই লেখককে মিশিয়ে ফেলে। এটা ঠিক না। লেখা এবং লেখক এক নয়।
আহ আমি ঠাট্টা করছিলাম।
ওসমান সাহেব থমথমে গলায় বললেন এই ব্যাপারটা নিয়ে ঠাট্টা আমার ভাল লাগে না।
তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন? রাগ করার মত কিছু তো আমি বলিনি। দাও মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।–নাকি অন্য কিছু চাই?
ওসমান সাহেব জবাব দেননি। পাশ ফেরে ঘুমুতে চেষ্টা করেছেন। ঘুম আসেনি। দুঃস্বপ্ন দেখার পর সাধারণত তাঁর ঘুম হয় না। আজও হবে না। অবশ্যি আর রাতও খুব বাকি নেই। আকাশ ফর্স হতে শুরু করেছে। কাক ডাকতে শুরু করবে। লেখক হয়েও অলেখক সুলভ চিন্তা করলেন। কাক ডাকতে শুরু করবে না বলে উচিত ছিল পাখি ডাকতে শুরু করবে।
তিনি চটি পায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। তাঁর গল্পের নায়কের সঙ্গে একটা মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। সেও দুঃস্বপ্ন দেখার পর বাকি রাতটা ঘুমুতে পারত না। বারান্দায় এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত হাঁটাহাঁটি করত। সূর্য ওঠার পর ঘুমুতে যেত। একজন নিঃসঙ্গ মানুষের গল্প। শেষ পর্যায়ে সে স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবকে গুলিয়ে ফেলে। চমৎকার একটি গল্প। শুধু চমৎকার নয় একটি অসাধারণ গল্প। আশ্চর্যের ব্যাপার, সমালোচকরা এই গল্পটিকে গুরুত্ব দেননি। কেন দেননি? ওসমান সাহেব ঠিক করে ফেললেন আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে পুরনো এই গল্পটি পড়বেন। স্বপ্ন দৃশ্যে বর্ণনাগুলি ভাল করে দেখা দরকার। এই গল্পে অতিপ্রকৃত আবহ তৈরির জন্যে প্রচুর তৎসম শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এতে কী গল্পের গাথুনি আলগা হয়ে গেছে?
সাদামাটা একটা সূর্য উঠল। ভোর হওয়া নিয়ে কবি সাহিত্যিকরা এত হৈচৈ করে কী জন্যে কে জানে? সূৰ্য ওঠার মধ্যে রহস্যময় কিছু নেই। জ্যোৎস্নায় কিছু রহস্য আছে। কাজেই চাঁদ নিয়ে কিছুটা মাতামাতি করা যেতে পারে। সূর্য নিয়ে নয়।
আকবরের মা উঠে পড়েছে। গ্যাসের চুলায় আগুন জ্বলছে চায়ের কেতলি বসানো হয়েছে। ভোর বেলার এই আয়োজনটি চমৎকার। দেখলেই মন ভাল হয়ে উঠতে শুরু করে।
আজ আমি লেখা নিয়ে বসব।
জি আইচ্ছা।
যেই আসুক বলবে আমি বাসায় নেই। কখন ফিরব তার ঠিক নেই। টেলিফোনেও একই কথা বলবে।
জি আইচ্ছা। ফেলাস্কে চা বানাইয়া দিমু?
না, চা-টা লাগবে না।
অনেক দিন পর লেখার টেবিলের কাছে এসেছেন। সাদা খাতা খোলা দেখলেই কিছু একটা লিখতে ইচ্ছা কবে। অরণ্য এগিয়ে আসছে এই গল্পটি লিখে ফেললে কেমন হয়?
অরণ্য এগিয়ে আসছে। ছোট শহরের সবাই বুঝতে পারছে পালানোর পথ নেই। প্রথম কযেক পৃষ্ঠায় এই বর্ণনাটিই থাকবে। কিন্তু লেখাটা আসছে না।
টেবিলে এক পাশে মিমির প্যাকেট। লাল লাল পিপড়া প্যাকেটটি ছেকে ধরেছে। টগরকে দেয়া হয়নি। কেন দেয়া হয়নি? হাতেই তো ছিল। তবু শেষ মুহূর্তে দেয়া হল না কেন? তিনি কী টগরকে ভালবাসেন না? কিন্তু তা কি করে হয়!
ওসমান সাহেব মিমির প্যাকেটটি তার লেখার কাগজের উপর এনে রাখলেন। পিপড়াদের মধ্যে একটি সাড়া পড়ে গেল। হঠাৎ বস্তুর অবস্থানগত পরিবর্তন কেন হল তারা বুঝতে পারছে না। ছোটাছুটি করছে পাগলের মত। ওসমান সাহেব মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলেন।
রানুর ঘুম ভাঙল খুব ভোরে।
অভ্যাস মত টগরের গায়ে হাত রাখল। গা গরম। টেম্পারেচার কত হবে? রাত দুটোর দিকে একবার টেম্পারেচার নেয়া হয়েছিল, নিরানব্বই। এখন বোধ হয় তার চেয়েও বেশি। রানু টগরকে নিজের কাছে নিয়ে এল। গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে উত্তাপ যদি কিছু কমিয়ে দেয়া যায়। এত ভুগে কেন সে? দু’দিন পর পর অসুখ। হাম থেকে উঠবার পরই এক নাগাড়ে সাতদিন সর্দিজুর। সেই জ্বর সারল, সঙ্গে সঙ্গে হল আমাশা। একটা কিছু লেগেই আছে। শরীর শুকিয়ে কাঠির মত হয়েছেশুধু মুখটা শুকায়নি। বড়সড় একটি মুখে দু’টি বিশাল চোখ। ওর বাবার চোখ পেয়েছে। শুধু চোখ নয়। বাবার স্বভাব-চরিত্রও বোধ হয় কিছু পেয়েছে। কোনো ব্যাপারেই কোনো অভিযোগ নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক জায়গায় বসে থাকতে পারে।