- বইয়ের নামঃ দূরে কোথাও
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ মাওলা ব্রাদারস
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
আকাশে মেঘ করেছে
আকাশে মেঘ করেছে।
ঘন কালো মেঘ। ক্রমেই ফুলে ফোঁপে উঠছে।
ওসমান সাহেব আকাশের দিকে তাকালেন। তার কেন জানি মনে হল এই মেঘে বৃষ্টি হবে না। প্রিকগনিশন নাকি? ভবিষ্যতের কথা আগে ভাগে বলে ফেলা। তিনি হাঁটছেন অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে। উদ্দেশ্যহীন মানুষের হাঁটা। গন্তব্যহীন যাত্ৰা। অথচ তার একটি গন্তব্য আছে। বি.ডি.আর-এর তিন নম্বর গেট পার হয়ে তিনি ঢুকে যাবেন নিউ পল্টন লাইনের গলিতে। গোরস্থানের দেয়াল ঘেঁষে এগুতে থাকেন।
স্নামালিকুম।
ওসমান সাহেব চমকে তাকালেন। সালামটা কী তাকেই দেয়া হয়েছে? দু-একজন কী চিনতে শুরু করেছে? চেনার কথা নয়। তিনি মাসের দুবারের বেশি আসেন না। এদিকে। সালাম দেয়া ছেলেটির বয়স অল্প। চোখে চশমা। সে তাকাচ্ছে কৌতূহলী হয়ে। ওসমান সাহেব প্রশ্রয়ের হাসি হাসলেন। এবং মৃদু স্বরে বললেন–ভাল তো?
আপনি কী এই পাড়াতে থাকেন?
না। তবে মাঝে মাঝে আসি।
আমি আগেও একবার দেখেছি। তখন চিনতে পারিনি।
তিনি মৃদু হেসে হাঁটতে শুরু করলেন। পেছন না ফিরেও বুঝতে পারছেন ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে। তার হয়ত আরও কিছু কথা বলবার ছিল।
ওসমান সাহেব ঘড়ি দেখলেন–পাঁচটা দশ। তিনি সব সময় চারটার মধ্যে এসে পড়েন। আজ অনেকখানি দেরি করলেন। তার চরিত্রের সঙ্গে এটা খাপ খায় না। রানুকে পাওয়া যাবে কী? দেরি দেখে কোথাও চলে যায়নি তো?
রানুরা থাকে তিন তলার শেষ মাথায়। ছোট্ট এক চিলতে বারান্দা আছে তাদের। সে সেখানে দু’টি টবে মরিচ গাছ লাগিয়েছে। গোলাপ-টোলাপ না লাগিয়ে মরিচ গাছ লাগানোটা উদ্দেশ্যমূলক। উদ্দেশ্যটা কী?
তিনি বারান্দায় কাউকে দেখলেন না। সাধারণত টগর রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। ওরা কী নেই আজ? টগরের জন্যে এক প্যাকেট মিমি-এনেছেন। তিনি মিমির প্যাকেট হাতে নিয়ে নিলেন। আজ যেন গতবারের মত না হয়। গতবার পেয়ারা নিয়ে গিয়েছিলেন মনের ভুলে দেয়া হয়নি।
ওরা কী সত্যি সত্যি নেই? সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে তার মনে আশা ভঙ্গের বেদনা জাগতে লাগল। সিঁড়ি অন্ধকার। কে যেন জায়গায় জায়গায় পানি ফেলে রেখেছে। রানুকে বলতে হবে এ বাড়ি ছেড়ে দিয়ে ভাল একটা জায়গায় বাড়ি নিতে।
কলিং বেলে হাত রাখতেই দরজা খুলে গেল। যেন দরজার পাশেই রানু অপেক্ষা করছিল। ওসমান সাহেব মৃদু গলায় বললেন–একটু দেরি করে ফেললাম। রানু কিছু বলল না।
টগর কী বাসায় নেই?
না।
কোথায় গিয়েছে?
খালার বাসায় গেছে। এসে পড়বে।
তিনি ইতস্তত করে বললেন–আমি কী ওর জন্যে অপেক্ষা করব?
ইচ্ছা করলে কর।
তিনি বসতে বসতে বললেন–তুমি ভাল আছ তো? রানু জবাব দিল না। ওসমান সাহেব বললেন–ঘরে কী মাথা ধরার টেবলেট আছে? রানু হ্যাঁ না কিছুই বলল না। পাশের ঘরে চলে গেল। তাঁর মনে হল রানু অনেক রোগা হয়ে গেছে। অসুখ-বিসুখ হয়েছে কী? রোগা হবার জন্যেই বোধ হয় তাকে উনিশ-কুড়ি বছরের তরুণীর মত লাগছে। তিনি মনে মনে রানুর বয়স হিসেব করতে চেষ্টা করলেন। বিয়ে হয়েছিল। ষোল বছর বয়সে। সেও তো পাঁচ বছর হল। তার মানে রানুর বয়স এখন একুশ। এত অল্প।
পাশের ঘরে খুটি খুঁট শব্দ হচ্ছে। ওটা কী রান্না ঘর? এখানে সব মিলিয়ে কটি রুম কে জানে! কিছুই তিনি জানেন না। রানুর শোবার ঘরটি কেমন? খুব গোছানো নিশ্চয়ই। এমনিতেই রানুর খুব গুছিয়ে রাখার স্বভাব। টুথপেস্টের মুখ খুলে রাখলে সে রাগ করত। মাথা আঁচড়ে চিরুনি ড্রেসিং টেবিলের উপর না রেখে অন্য কোথাও রাখলে গম্ভীর হয়ে যেত।
দুলাভাই, আপনার ওষুধ নিন।
কামিজ পরা লম্বা বেণীর মেয়েটি প্রায় নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি মেয়েটিকে চিনতে পারলেন না। দুলাভাই সম্বোধনে বিব্রতবোধ করতে লাগলেন।
আমাকে বোধ হয় চিনতে পারেননি, তাই না?
চেনা চেনা লাগছে অবশ্যি।
মোটেই চেনা চেনা লাগছে না। আপনি আমাকে দেখেছেন মাত্র একবার। আপনার বিয়ের সময়। তখন আমার চেহারা অন্য রকম ছিল।
এখন চেহারা বদলে গেছে?
হ্যাঁ।
তুমি কে?
আমার নাম অপলা। আমি রানু আপার দূর সম্পর্কের বোন হই।
তিনি দু’টি ট্যাবলেটের একটি গিলে ফেলে অন্যটি পকেটে রাখলেন, শান্ত স্বরে বললেন। আমি একসঙ্গে দু’টি ট্যাবলেট গিলতে পারি না, বমি হয়ে যায়, কাজেই বাকিটা খাব দুঘণ্টা পর।
এর মধ্যেই হয়ত আপনার মাথাব্যথা সেরে যাবে।
না, সারবে না। আমার এত সহজে কিছু সারবে না।
ওসমান সাহেব লক্ষ্য করলেন অপলা মেয়েটি বেশ সহজভাবেই আলাপ করছে, মেয়েটা রানুর অন্য আত্মীয়দের মত নয়।
দুলাভাই আপনি কী বারান্দায় বসবেন? এখানে ফ্যান নেই। আপনার গরম লাগছে নিশ্চয়ই।
না, থাক।
চলুন আমি চেয়ার নিয়ে দিচ্ছি।,
আমি বারান্দায় বসলে তোমার আপা সেটা পছন্দ করবে না। সে চায় না লোকজন দেখুক আমি তার এখানে আসি।
অপলা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে চুপ করে রইল। ওসমান সাহেবের মনে হল, এটা না বললেই পারতেন। কেন এটা বললেন? তিনি কী অবচেতন মনে মেয়েটির সহানুভূতি চাচ্ছিলেন?
অপলা বলল বসুন চা নিয়ে আসি। তিনি দীর্ঘ সময় বসে রইলেন একা একা। বসে থাকতে তার কখনো খারাপ লাগে না, আজ লাগছে। চলে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে। এতক্ষণ তার গরম লাগেনি। এখন লাগছে। রানুর শোবার ঘরে ফ্যান আছে কী? তিনি ঠিক করে রাখলেন রানু এলেই জিজ্ঞেস করবেন। শুধু এটিই নয়। তার আরো কিছু জািনবার আছে। যেমন পুরুষ মানুষ কেউ কী থাকে রানুদের সঙ্গে? তিনি যতবার এসেছেন কোন বারই পুরুষ কাউকে দেখেননি। একবার এসে এশট্রেতে ছটা সিগারেটের টুকরো দেখেছেন। যে এসেছিল। সে নিশ্চয়ই নার্ভাস প্রকৃতির লোক; কারণ কোন সিগারেটই পুরোপুরি শেষ করেনি। একটি তো প্রায় আস্তই ছিল।