জানি, মিতু বলেছে।
অবশ্যি আমি ডাক্তারী প্র্যাকটিস করছি না। কিছুই মনে রাখতে পারি না। ভুলে যাই। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সোডিয়াম ইনটেক কতটুকু প্রয়োজন অনেকক্ষণ ধরে মনে করার চেষ্টা করছি, পারছি না।
মনে রাখার চেষ্টা খুব বেশী করছেন বলে এই সমস্যা হচ্ছে। আপনি এক কাজ করুন, ভুলে যাবার চেষ্টা করুন। এতে ফল হতে পারে।
সাবের বিস্মিত হয়ে বলল, ভুলে যাবার চেষ্টা কিভাবে করব?
মনে রাখার চেষ্টা যেভাবে করেন তার উল্টোভাবে করবেন।
মনে রাখার চেষ্টা আমি কিভাবে করি?
লোকটি এর উত্তরে হেসে ফেলল। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সাবেরের মনে পড়ল একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্যে দৈনিক ১ থেকে ২ গ্রাম খাবার লবণই যথেষ্ট অথচ সে বোজ ১০ থেকে ১২ গ্রাম খাবার লবণ খায়।
সাবের বিস্মিত হয়ে বলল, মনে পড়েছে।
লোকটি বলল, জানতাম মনে পড়বে।
সাবের বলল, আপনাকে ইন্টারেস্টিং মানুষ বলে মনে হচ্ছে।
আপনাকেও ইন্টারেস্টিং মানুষ বলে মনে হচ্ছে। আচ্ছা, আপনি আমাকে একটা ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবেন? ইংরেজী কবিতার দুটা লাইনের সুন্দর বাংলা করে দেবেন–
Remember me when I am gone away,
Gone far away into the silent land.
সাবের তৎক্ষণাৎ বলল,
মনে রেখ যখন চলিয়া যাব দূরে
নৈঃশব্দের দূর নগরীতে।
লোকটি বলল, বাহ সুন্দর তো। সাবের খানিকটা হকচকিয়ে গেল। চট করে তার মাথায় এমন সুন্দর দুটা লাইন কি করে এল, সে বুঝতে পারছে না। লাইন দুটা মাথা থেকে চলে যাচ্ছে না–ঘুরপাক খাচ্ছে। আপনা আপনি অন্য রকম করে সাজানো হচ্ছে–
যখন চলিয়া যাব দূরে
বহু দূরে। নৈঃশব্দের দূর নগরীতে–
তিনবার দূর শব্দটা ব্যবহার করায় মনে হচ্ছে অনেক অনেক দূরের কোন জায়গার কথা বলা হচ্ছে। মানুষের চিন্তা এবং কল্পনার বাইরের কোন নগরী, যে নগরী অস্পষ্ট এবং রহস্যময়।
সাবের বলল, আপনার পাশে বসি খানিকক্ষণ?
বসুন। বৃষ্টিতে ভিজে আবার অসুখ করবে না তো? ভাইরাস যদি ধরে। ইনফ্লুয়েঞ্জা, রেসপিরেটরী ট্র্যাক্ট ইনফেকশন।
ধরুক। কদিন আর বাঁচব। মরতে তো হবেই তাই না? যেতে হবে অনেক দূরের দেশে। দূরে, বহু দূরে, নৈঃশব্দের দূর নগরীতে।
সাবের বসল তার পাশে। দুজনই বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল। মিতু জানালা থেকে পুরো ব্যাপারটা দেখছে। সে মনে মনে বলল, পাগলে পাগলে খুব মিল। হয়েছে। মিতুর খুব হাসি পাচ্ছে। সে হেসে ফেলল। খিল খিল হাসি। মিস্টার জুলাই হাসির শব্দ শুনে তাকাল মিতুর দিকে। মিতুর আরো বেশী বেশী হাসি। আসছে।
জুবায়ের আসতে আসতে রাত দশটা বাজিয়ে ফেলল।
ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। দুএকটা তারাও উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে।
জুবায়ের এষার দিকে তাকিয়ে লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, সরি। সময়মতই রওনা হচ্ছিলাম। গাড়িতে উঠতে যাব–এক গেস্ট এসে উপস্থিত। এমন গেস্ট যে বলা যায় না–ভাই এখন যান জরুরী কাজে যাচ্ছি।
এষা বলল, এত সাফাই গাচ্ছ কেন? জরুরী কাজ তো কিছু না।
জুবায়ের বিস্ময়ের ভঙ্গি করে বলল, দুজন এক সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজব এটা জরুরী না? কি বলছ তুমি? স্নান করব নীপ বনে, ছায়াবীথি তলে–এটা যদি জরুরী না হয় তাহলে …..
তুমি কি খেয়ে এসেছ?
না।
ভাল করেছ। এক সঙ্গে খাব। তুমি কি এখনি খাবে? খাবার গরম করতে বলব?
বল। এই ফাঁকে আমি চট করে তোমার মাতৃদেবীর সঙ্গে দেখা করে আসি।
প্লীজ এখন মাকে বিরক্ত করো না। মার মাথা ধরেছে। মা দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছেন। এখন গেলেই মা রাগ করবেন।
পৃথিবীর কেউ আমার উপর রাগ করতে পারে না।
মা পারে। এখন তুমি মার ঘরে ঢুকলে মা তোমাকে ধমক দিয়ে বের করে দেবে–এটা ভাল হবে? তারচে, চল খাওয়া-দাওয়া করা যাক।
রাতের খাবার শেষ করে জুবায়ের সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, চল ছাদে যাই। ছাদে হাঁটাহাঁটি করে আসি। আফটার ডিনার ওয়াক এ মাইল।
এষা বলল, পাগল এখন ছাদে যাব কি? বৃষ্টিতে ছাদ পিছল হয়ে আছে।
জুবায়ের খানিকটা গম্ভীর হয়ে গেল।
এষা বলল, পান খাবে? পান এনে দেব?
না।
কি ব্যাপার তুমি হঠাৎ এমন গম্ভীর হয়ে গেলে কেন?
জুবায়ের বলল, তোমার ব্যাপারে আমার একটা অবজারভেশন আছে। তুমি কোন নির্জন জায়গায় আমার সঙ্গে থাকতে চাও না। এক ধরনের অস্বস্তি বোধ কর। এর কারণ কি বল তো? একজন মৌলানার সামনে তিনবার কবুল বলিনি–এই কি কারণ?
এষা বলল, কি বলছ এসব? হয়েছে কি তোমার? ছাদে যেতে চাচ্ছি না। কারণ ছাদ পিছল হয়ে আছে। তারপরেও তুমি যদি যেতে চাও–খুব ভাল কথা। চল যাই–পা পিছলে কোমর ভাঙ্গলে কিন্তু আমাকে দোষ দেবে না।
জুবায়ের বলল, যেদিন ছাদ শুকনো থাকে সেদিনও কিন্তু যেতে চাও না। গত সপ্তাহের কথা কি তোমার মনে আছে? তোমাকে বললাম, চল ছাদে যাই। তুমি বললে–তুমি যাও আমি আসছি। আমি অপেক্ষা করছি। তুমি এলে ঠিকই, মিতুকে সঙ্গে নিয়ে এলে।
এষা বিরক্ত গলায় বলল, মিতু আমার সঙ্গে আসতে চাচ্ছিল। আমি কি করব? মিতুকে বলব–না তুমি যেতে পারবে না। আমাকে এক-একা যেতে হবে যাতে অন্ধকারে ঐ লোকটা আমাকে জড়িয়ে ধরতে পারে। লোকটাকে এই সুযোগ দিতে হবে কারণ দুদিন পর সে আমাকে বিয়ে করছে।
তুমি রেগে যাচ্ছ এষা।
সরি।
আশ্চর্য! তুমি এত চট করে রেগে যাও। দেখি একটা পান দাও তো খাই।
এষা পান এনে দিল।
জুবায়ের দ্বিতীয় সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আচ্ছা ঐ লোকের খবর কি? তার বাড়িঘরের কোন খোঁজ পাওয়া গেছে?