নাম তো বাবা দেয়া হয়েছে।
কি নাম?
নাম হচ্ছে জুলাই।
জুলাই?
হ্যাঁ, জুলাই। মিতু নাম রেখেছে। এখন জুলাই মাস, কাজেই তার নাম জুলাই। যখন আগস্ট মাস আসবে তখন তার নাম হয়ে যাবে আগস্ট। মিতুর খুব ইচ্ছা–লোকটা যেন সারাজীবন এই বাড়িতে থাকে, যাতে সে প্রতিমাসে একবার করে নাম বদলাতে পারে।
এষা খিল খিল করে হেসে উঠল। মতিন সাহেব বললেন, আরেক কাপ চা আন তো মা।
আরেক কাপ চা এনে দিচ্ছি–কিন্তু বাবা তুমি তোমার সিগারেটের প্যাকেটটা আমাকে দিয়ে দাও। এরপর তোমার সিগারেট খেতে ইচ্ছা করলে–আমার কাছে চাইবে।
মতিন সাহেব সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে দিলেন।
এষা চা বানিয়ে এনে দেখে, তার বাবা ঘুমুচ্ছেন। তন্দ্রা নয়–বেশ ভাল ঘুম। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত একজন মানুষের ঘুম। এষার তাকে জাগাতে ইচ্ছা করল না। সে চায়ের কাপ নিয়ে বাগানে নেমে গেল। জুলাই নামের লোকটাকে দিয়ে আসা যাক। তার সঙ্গে কথাও হয়নি। কিছুক্ষণ কথা বলা যেতে পারে। তবে নিজের হাতে চা নিয়ে যাওয়াটা বাড়াবাড়ি হচ্ছে। লোকটা লাই পেয়ে যেতে পারে; বরং সে নিজেই নিয়ে এসে চা খাবে। চা খেতে খেতে দুএকটা কথা বলবে।
বাগানের এই দিকটা অন্ধকার। চল্লিশ পাওয়ারের একটা বা ফিউজ হয়েছে, নতুন বাল্ব লাগানো হয়নি। তবে রাস্তার ল্যাম্প পোস্টের আলো খানিকটা এসেছে এদিকে। সেই আলোয় অস্পষ্ট করে হলেও সবকিছু চোখে পড়ে। লোকটিকে কাঁঠাল গাছের নীচে পা তুলে বসে থাকতে দেখা গেল।
বসে থাকার ভঙ্গিটি মজার। পা তুলে পদ্মাসনের ভঙ্গিতে বসা। শিরদাঁড়া সোজা করা। ধ্যান-ট্যান করছে না-কি? লোকটা বসেছে উল্টোদিকে। এষা এগুচ্ছে পেছন দিক থেকে। লোকটার মুখ দেখতে পারছে না। পেছন দিক থেকে একটা মানুষের কাছে যেতে ভাল লাগে না।
কেমন আছেন?
লোকটা চমকে উঠল। উঠে দাঁড়াল সঙ্গে সঙ্গে। এষা বলল, আমি মিতুর বড় বোন। লোকটা নীচু গলায় বলল–জ্বি, আমি জানি। মিতু বলেছে।
আপনি বসুন, দাড়িয়ে আছেন কেন?
লোকটি বলল, আপনিও বসুন।
কথাগুলি এত সহজ এবং এত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলা হল যেন দীর্ঘদিনের পরিচিত একজন মানুষ কথা বলছে। এষা বসল। বসতে বসতে বলল, বাবা আপনার খোঁজ বের করার খুব চেষ্টা করছেন। আপনার ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। আপনি কি দেখেছেন?
দেখেছি।
থানায় খবর দেয়া হয়েছে। যেখান থেকে আপনাকে তুলে এনেছেন সেখানেও লোক পাঠানো হয়েছে।
আমি জানি। আপনার বাবা আমাকে বলেছেন।
আপনি কি কিছুই মনে করতে পারেন না?
জি না।
এর জন্যে আপনার মন খারাপ লাগছে না?
না।
আশ্চর্য! আপনার আত্মীয়-স্বজন কারা, তারা কোথায় আছেন–এই ভেবে মন খারাপ হচ্ছে না?
লোকটি চুপ করে রইল।
এষা বলল, আপনার আত্মীয়-স্বজনরা নিশ্চয়ই খুব দুঃশ্চিন্তায় আছেন। ছোটাছুটি করছেন।
লোকটি চুপ করেই রইল। যেন এই প্রসঙ্গে সে কোন কথা বলতে আগ্রহী নয়। এষা বলল, আপনার পড়াশোনা কতদূর?
জানি না।
আচ্ছা আমি একটা ইংরেজী কবিতা বলি আপনি এর বাংলা কি, বলুন তো
Remember me when I am gone away.
Gone far away into the silent land.
আমি অর্থ বলতে পারছি না।
আপনি কি ইংরেজী জানেন না?
ঠিক বুঝতে পারছি না। মনে হয় জানি না।
ও আচ্ছা। আমার মনে হচ্ছিল, আপনি ইংরেজী জানেন।
আমি জানি না।
এষা উঠে দাঁড়াল। লোকটি বলল, চলে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ, আপনিও ঘরে চলে যান। বৃষ্টি নামবে। দেখুন আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
লোকটি জবাব দিল না।
রাত নটার দিকে বৃষ্টি নামল। এষা নিজের ঘরে পড়ছিল। মালী এসে বলল, আপা লোকটা কঁঠাল গাছের নীচে বইয়া বৃষ্টিতে ভিজতাছে।
কেন?
জানি না। ঘরে যাইতে বললাম, যায় না।
না গেলে না যাবে। ভিজুক।
পাগল-ছাগল মানুষ বাড়িতে রাখা ঠিক না আপা।
তোমাকে উপদেশ দিতে হবে না। তুমি তোমার নিজের কাজ কর।
মালী চলে গেল। এষা জানালার কাছে গিয়ে পর্দা সরিয়ে উঁকি দিল। লোকটা বসে আছে। বৃষ্টিতে ভিজছে। তার মধ্যে কোন রকম বিকার নেই। যেন একটা পাথরের মূর্তি। লোকটা কি পাগল? কথাবার্তায় অবশ্যি মনে হয়নি। ইংরেজী জানে না–তার মানে মূর্খ ধরনের মানুষ।
কাজের মেয়েটি এসে বলল, আপা আপনার টেলিফোন।
কার টেলিফোন?।
কাজের মেয়েটি মুখ টিপে হাসল। যার মানে এই টেলিফোন জুবায়ের করেছে। জুবায়ের টেলিফোন করলেই এ বাড়িতে এক ধরনের চাপা হাসি হাসা হয়। এর কোন মানে আছে?
এষা টেলিফোন ধরল।
কে এষা?
হ্যাঁ।
তোমাদের এদিকে কি বৃষ্টি হচ্ছে?
হ্যাঁ। হচ্ছে।
অল্প-স্বল্প না ক্যাটস এণ্ড ডগস?
ভালই হচ্ছে।
বৃষ্টিতে ভিজবে এষা?
না।
না কেন?
আগে একবার তোমার সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজেছি, তারপর তুমি যে কাণ্ড করেছো তারপর আমার আর সাহসে কুলায় না।
আজ আমি সন্ন্যাসীর মত আচরণ করব। তোমার কাছ থেকে সবসময় চার হাত দূরে থাকব। ওয়ার্ড অব অনার। চলে আসব?
আস।
ভাল কথা, ঐ লোকটার কোন খোঁজ পাওয়া গেছে? মিঃ জুলাই?
না।
লোকটার সম্পর্কে আমার কি ধারণা শুনতে চাও? আমার ধারণা ব্যাটা একটা ফ্রড। বিরাট ফ্রড। স্মৃতিশক্তি হারানোর ভান করে তোমাদের এখানে মজায় আছে।
আমাদের এখানে মজার কি আছে।
ফুড এণ্ড শেলটার আছে। এই শহরে কটা লোকের ফুড এণ্ড শেলটার আছে জান? এবাউট ফটি পারসেন্ট লোকের নেই। তোমরা এক কাজ কর। ঘাড় ধরে ঐ লোকটাকে বের করে দাও।
লোকটার উপর তোমার এত রাগ কেন?
ফ্রড লোকজন আমি সহ্য করতে পারি না। লোকটার গালে পঞ্চাশ কেজি ওজনের দুটো চড় দিলেই দেখবে হারানো স্মৃতি ফিরে এসেছে। ফড় ফড় করে কথা বলছে।