এক তলায় একটা ঘর তাকে দেয়া হয়েছে। নির্বিকার ভঙ্গিতেই সে সেই ঘরে আছে। খাওয়া-দাওয়া করছে, ঘুমুচ্ছে। যেন এটা তার নিজেরই ঘরবাড়ি। মাঝে মাঝে গুন গুন করে গান গাইতেও শোনা যাচ্ছে। একটিই গান–
সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা
কহে কানে কানে শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গল বারতা।
মতিন সাহেব লোকটির খোঁজ বের করার ভালই চেষ্টা করেছেন। থানায় ডায়েরী করিয়েছেন। দুটি দৈনিক পত্রিকায় সন্ধান চাই বিজ্ঞাপন ছবিসহ ছাপা হয়েছে। এ্যাকসিডেন্ট যেখানে হয়েছিল সেখানেও লোক পাঠিয়েছিলেন। কেউ কোনরকম সন্ধান দিতে পারেনি। মতিন সাহেব বুঝতে পারছেন না, তার কি করণীয় আছে। তিনি মনে মনে ঠিক করে রেখেছেন আরো তিন-চারদিন দেখে লোকটাকে যেখান থেকে তুলেছেন সেখানে রেখে আসবেন। কাজটা অমানবিক হলেও কিছু করার নেই। সঙ্গে কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে দিলেই হবে। লোকটি স্মৃতিশক্তি তার কারণেই হারিয়েছে তাতো নাও হতে পারে। হয়ত আগে থেকেই স্মৃতিশক্তি ছিল না।
বুধবার সন্ধ্যা।
মতিন সাহেব বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে আছেন। এষা ট্রেতে করে চা, এক পিস কেক এবং কলা এনে সামনে রাখল। মতিন সাহেব বললেন, কেমন আছ মা?
এষা হাসি মুখে বলল, ভাল আছি। তুমি কেমন আছো বাবা?
আমি মন্দ আছি।
পিতা এবং কন্যা দুজনই একসঙ্গে হেসে উঠল। এষা কথা বলা শেখার পর থেকে এই জাতীয় বাক্যালাপ দুজনের মধ্যে চলছে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ধরনটা একটু পাল্টাচ্ছে। এষার পাঁচ বছর বয়সে কথাবার্তা হত এ রকম :
মতিন সাহেব উঁচু গলায় বলতেন, কেমন আছ মা-মণি।
এষা প্রায় চিৎকার করে বলতো, তুমি কেমন আছো বাবা-মণি।
আমি মন্দ আছি।
আমিও মন্দ আছি।
হি হি হি।
আজ দুজনেরই বয়স বেড়েছে কিন্তু এই একটা জায়গায় যেন বয়স আটকে আছে। এষা বাবার সামনে চা রাখল। কোমল গলায় বলল, কলার খোসা ছাড়িয়ে দেব বাবা? মতিন সাহেব বললেন, তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে কলার খোসা ছড়ানো দারুণ কঠিন কাজ। এই কঠিন কাজটা করে তুই আমাকে সাহায্য করতে চাস। কিছু করতে হবে না–তুই আমার সামনে বোস। বসতে বলার দরকার ছিল না–এষা নিজ থেকেই বসত। সন্ধ্যাবেলা বেশ কিছুটা সময় সে বাবার সঙ্গে বসে। মতিন সাহেব মেয়ের কাছ থেকে বাড়ির সারাদিনের খবরাখবর নেন। এষাকে এ বাড়ির গেজেট বলা চলে। কিছুই তার চোখ এড়ায় না। বলেও খুব গুছিয়ে।
মতিন সাহেব চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন, আজ তোর মা আছে কেমন?
জানি না। ইউনিভার্সিটিতে যাবার আগে উঁকি দিয়েছিলাম। মা খ্যাক করে উঠেছেন–কেন ডিসটার্ব করছ?
বেচারী খেটেখুটে বাসায় আসে। ডিসটার্ব না করলেই হয়।
ডিসটার্ব আবার কি? আমি মার সঙ্গে কথাও বলব না?
যখন মন টন ভাল থাকবে তখন কথা বলবি?
তার মন কখনোই ভাল থাকে না।
তাও ঠিক।
আরেকটা খবর আছে বাবা।
বলে ফেল।
হরিপ্রসন্ন স্যার এসেছেন।
মতিন সাহব বিরক্ত মুখে বললেন, কেন?
কিছু বলেন নি। দেখে মনে হল খুব অসুস্থ। তুমি কি তার সঙ্গে কথা বলবে? ডাকব?
না এখন কথা বলব না। মনটা ভাল না।
মন ভাল না কেন?
তিনি উত্তর দিলেন না। সিগারেট ধরালেন। তিনি এখন পুরোদমে সিগারেট খাচ্ছেন। দিনে এক প্যাকেটের বেশী লাগে।
এষা একটু চিন্তিত বোধ করল। বাবার সিগারেট শুরু করা মানে তার ওষুধের কারখানায় বড় ধরনের কোন সমস্যা। যে সমস্যা নিয়ে তিনি কখনো কারো সঙ্গে কথা বলেন না।
সাবেরের খবর কি রে?
দাদা ভালই আছে। একটা নর কংকাল কিনে এনেছে। অস্থিবিদ্যা যা শিখেছিল সব ভুলে গেছে। আবার নতুন করে নাকি শিখতে হবে।
মতিন সাহেব গম্ভীর হয়ে গেলেন। এষা বলল, মার সঙ্গে দাদাকেও নিয়ে। যাও। তাকেও কোন একজন বড় সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো দরকার। আরেক কাপ চা দেব বাবা?
না।
তুমি আবার সিগারেট ধরিয়েছ। তোমার কারখানায় কি কোন সমস্যা হচ্ছে? মতিন সাহেব এই প্রশ্নেরও জবাব দিলেন না। মনে হল তিনি শুনতে পাননি। এষা বলল, তুমি তো ঐ লোকটা সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করলে না।
কোন লোকটা?
ঐ যে যাকে নিয়ে এসেছ। এ্যামনেশিয়া হয়েছে।
ওর কোন খবর আছে নাকি?
না। দিব্যি খাচ্ছে-দাচ্ছে, ঘুমুচ্ছে। মনে হচ্ছে এ বাড়িতে সে সুখে আছে।
কারো সঙ্গে কথাটথা বলে না?
নিজ থেকে বলে না। কেউ কিছু বললে খুশী হয়ে জবাব দেয়। আজ দুপুরে ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে দেখি সে কাঁঠাল গাছের নিচে বসে মিতুর সঙ্গে লুডু খেলছে।
তুই কি কথা বলেছিস?
না। কথা বলতাম। কিন্তু লোকটাকে আমার কেন জানি পাগল মনে হয়। চোখের দৃষ্টি যেন কেমন।
আরে দূর–চোখের দৃষ্টি ঠিকই আছে। লোকটা কিছু মনে করতে পারছে এই জন্যে তুই ভয় পাচ্ছিস। তোর কাছে মনে হচ্ছে লোকটা পাগল। তুই বরং লোকটার সঙ্গে কথা বল।
কেন?
কথা বললে বুঝতে পারবি–তার ব্যাকগ্রাউণ্ড কি? কি ধরনের ফ্যামিলি থেকে এসেছে। পড়াশোনা কি। এতে লোকটাকে ট্রেস করতে সুবিধা হবে।
তুমি তো অনেক কথা বলেছ–তোমার কি মনে হয়?
মতিন সাহেব খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমি বুঝতে পারছি না। আমি খানিকটা কনফিউজড।
সে কি?
মতিন সাহেব আরো একটা সিগারেট ধরালেন। সিগারেট ধরাতে ধরাতে লক্ষ্য করলেন, লোকটা হেঁটে হেঁটে কাঁঠাল গাছগুলির দিকে যাচ্ছে। মতিন সাহেব বললেন, লোকটার একটা নাম দরকার। এমিতে ডাকার জন্য একটা নাম। যতদিন আসল নাম পাওয়া না গেছে ততদিন এই নামে ডাকব।