বাড়িতে চেনে না। যাবে কি ভাবে?
তুই কি করতে বলছিস?
কয়েকদিন আমাদের বাসায় থাকুক। তুমি খোঁজ করে তার আত্মীয়-স্বজন বের কর।
এটাও করা যেতে পারে।
মতিন সাহেব চেম্বারে ঢুকলেন। লোকটি খুশী খুশী গলায় বলল, আমার ব্লাড প্রেসার স্বাভাবিক। হার্ট বিটও স্বাভাবিক।
মতিন সাহেব বললেন, সব কিছু স্বাভাবিক হলেই ভাল।
তিনি লোকটিকে বাসায় নিয়ে এলেন।
মতিন সাহেবের বাসা বনানীতে
মতিন সাহেবের বাসা বনানীতে।
নিজের বাড়ি নয়–ভাড়া করা। পুরানো ধরনের বাড়ি। অনেকগুলি ঘর। সামনে ফাঁকা জায়গায় দেশী ফুলের গাছ। চাপা গাছ, কেয়া গাছ, হাসনাহেনা। জংলা জংলা ভাব আছে। বাড়ির দক্ষিণে দুটা ঝাকড়া কাঁঠাল গাছ। একটা কাঁঠাল গাছের তলা বাঁধানো। ছুটির দিনের দুপুরে মিতু এইখানে বসে একা একা সাপলুডু খেলে। কাঁঠাল তলার আরেকটা নাম আছে–কান্নাতলা। মন খারাপ হলে মিতু এখানে বসে কাঁদে।
এত বড় বাড়িতে মানুষের সংখ্যা অল্প।
মতিন সাহেবের স্ত্রী–সুরমা। তিনি মতিঝিল জনতা ব্যাংকের মহিলা শাখার ম্যানেজার। সারাদিন অফিসেই থাকেন। সন্ধ্যা নাগাদ ফিরে প্রথমেই সবাইকে খানিকক্ষণ বকা ঝকা করেন, তারপর উঠে যান দোতলায়। রোজ সন্ধ্যায় তাঁর মাথা ধরে। দোতলায় তাঁর ঘরে দরজা বন্ধ করে ঘণ্টা দুএক চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকেন। তারপর একতলায় নেমে এসে আবার সবাইকে খানিকক্ষণ বকা ঝকা করেন। ঝড় ঝাপ্টা বেশীর ভাগ যায় তাঁর বড় ছেলে সাবেরের উপর দিয়ে। সাবের এই পরিবারে বড় ধরনের সমস্যা তৈরী করেছে। সবাইকে অশান্তিতে ফেলেছে।
সাবের দোতলায় থাকে। একেবারে কোনার দুটি ঘর তার। একটি স্টাডি রুম, অন্যটি শোবার ঘর। সাবের তিন বছর আগে ডাক্তারী পাস করেছে। পাস করবার পরপরই ঘােষণা করেছে ডাক্তারী কিছুই সে শিখতে পারেনি। সে চিকিৎসার ক, খও জানে না। কাজেই ডাক্তারী করবে না। মতিন সাহেব সাবেরকে ডেকে বলেছিলেন, শুনলাম তুমি চাকরি-বাকরি নিতে চাও না–সত্যি?
সাবের শান্ত গলায় বলেছে, সত্যি। প্রাইভেট প্র্যাকটিসও করতে চাই না।
কেন চাও না?
আমি ডাক্তারী কিছুই শিখতে পারিনি।
পরীক্ষায় তো খুব ভাল রেজাল্ট করেছ।
তা করেছি, কিন্তু আমার কিছুই মনে নেই।
কিছুই মনে নেই বলতে কি মিন করছ?
যেমন ধর ডিপথেরিয়া। কিছুক্ষণ আগে ডিপথেরিয়া নিয়ে চিন্তা করছিলাম। ডিপথেরিয়াতে এন্টিটক্সিন দিতে হয় এবং এন্টিবায়োটিক দিতে হয়। এন্টিটক্সিনের ডোজ কিছুই মনে নেই। ডিপথেরিয়াতে কার্ডিয়াক ফেইলিউর হয়–কেন হয় তাও মনে নেই।
সব কিছু মনে থাকতে হবে?
অফ কোর্স মনে থাকতে হবে। মানুষের জীবন নিয়ে কথা।
তুমি তাহলে কি করবে?
আমি নিজে নিজে পড়ব। যেদিন বুঝব যা জানার সব জেনেছি সেদিন চিকিৎসা শুরু করব।
মতিন সাহেব বললেন, তুমি যা করছ তা যে এক ধরনের পাগলামি ত কি বুঝতে পারছ?
না বুঝতে পারছি না।
আমি কিছুই বলব না। এইসব পাগলামি তুমি তোমার মার কাছ থেকে পেয়েছ। তোমার মাকে আমি যেমন কিছু বলি না–তোমাকেও বলব না। তবে আশা করব যে, দ্রুত পাগলামি কাটিয়ে উঠবে।
সাবের মাথা নিচু করে রাখল। কিছু বলল না। মতিন সাহেব বললেন, বুঝতে পারছ কি বলছি?
পারছি।
পাগলামি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করবে।
জি আচ্ছা।
পাগলামি কাটিয়ে ওঠার কোন রকম লক্ষণ সাবেরের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। তার স্টাডি রুমে চিকিৎসা শাস্ত্রের রাজ্যের বই। সারাদিন সে বই পড়ে। যে সময়টা বই পড়ে না–বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করে। এমাথা ওমাথায় যায়–ওমাথা থেকে এমাথায় আসে। যা পড়েছে তা মনে করার চেষ্টা করে।
দোতলায় মার ঘরের পাশের ঘরে থাকে মিতু এবং এষা। মেজো মেয়ে এষা ইংরেজী সাহিত্যে সেকেন্ড ইয়ার অনার্স পড়ছে। রূপবতী না হলেও স্নিগ্ধ চেহারা, অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। তার বিয়ের কথা পাকা হয়ে আছে। ছেলেটির নাম জুবায়ের। লেদার টেকনোলজিতে জার্মানী থেকে ডিগ্রী নিয়ে এসেছে। নিজেই ছোটখাটো ইণ্ডাস্ট্রির মত শুরু করেছে। শুরুটা করেছে চমৎকার। জুবায়ের প্রায়ই এ বাড়িতে। আসে। বাড়ির প্রতিটি সদস্য এই ছেলেটিকে খুব পছন্দ করে।
মতিন সাহেবের বড় মেয়ের নাম নিশা। মাত্র কিছুদিন হল তার বিয়ে হয়েছে। এই মেয়েটি অসম্ভব রূপবতী। রূপবতীদের সাধারণ ত্রুটি–অহংকার তার মধ্যে পুরোপুরি আছে। নিশার স্বামী ফজলুর রহমান গোবেচারা ধরনের মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাথমেটিক্সের এসোসিয়েট প্রফেসর। নিশা এই বিয়েতে সুখী হয়নি বলে মনে হয়। বাবার বাড়িতে সে যখন আসে–স্বামী এবং শশুর বাড়ির বদনাম করতে আসে। মাঝে মাঝে কান্নাকাটিও করে।
মতিন সাহেব থাকেন এক তলায়। বলা চলে একা একাই থাকেন। এমনও দিন যায়–স্ত্রীর সঙ্গে তার কথাই হয় না। এই নিয়ে তাঁর মনে কোন ক্ষোভ আছে বলে মনে হয় না। মতিন সাহেবের পাশের ঘরে থাকে মিতুর ছোট মামা মন্টু। জগন্নাথ কলেজ থেকে দুবার বি.এ.পরীক্ষা দিয়ে ফেল করে সে। তৃতীয়বারের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মন্টুর ঘরের দরজায় বড় বড় করে লেখা–
মনোয়ার আহমেদ মন্টু
তার নিচে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা–বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ। মন্টুর ঘর দিন-রাতই খোলা। যার ইচ্ছা সে ঘরে ঢুকছে এবং বেরুচ্ছে। মতিন সাহেবের পরিবারের এই হচ্ছে মোটামুটি পরিচয়। এরা ছাড়াও দুজন কাজের লোক, একজন বাবুর্চি, একজন মালী, একজন দারোয়ান, একজন ড্রাইভার এ বাড়িতেই থাকে। এদের থাকার জায়গা বাড়ির পেছনের টিন শেডে। এইসব মানুষের সঙ্গে তিনদিন আগে আরেকজন মানুষ যুক্ত হয়েছে যার কোন নাম নেই এবং যে পুরানো কোন কথা মনে করতে পারছে না।